হযরত হালিমা রা. এর ঘরে নবিজী সা. -এর প্রতিপালন এবং অলৌকিক ঘটনা!

যুগ যুগ ধরে আরবের রীতি ছিল স্বীয় নবজাতককে জন্মের পর শহরের নিকটবর্তী গোত্রের কোন দুগ্ধমাতার নিকট অর্পণ করতে হবে। এতে করে তারা তাদের দৈহিক সুস্থতার অনুকুল পরিবেশ পাবে। সে আলোকে প্রিয়নবি মুহাম্মদও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। এছাড়াও যেহেতু সন্তানকে পান করানোর জন্যে মা আমিনার দুধ ছিল না, সেহেতু হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পিতামহ ও অভিবাবক আবদুল মুত্তালিব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর স্মৃতিচিহ্ন প্রিয় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে কোন পবিত্র ও সম্মানিতা নারীর অনুসন্ধান করলেন।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের কিছুদিন পর মক্কা পল্লীর হাওয়াযেন গোত্রের বনি সাদ বিন বকর শাখার কতিপয় দুগ্ধদানকারী নারী নবজাতক নেয়ার জন্য পবিত্র নগরী মক্কায় আসেন। কাফেলার সবাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ তিনি ছিলেন পিতৃহীন, ইয়াতিম। যথাযথ পারিশ্রমিক ও উপঢৌকন না পাওয়ার ভয়ে তারা প্রিয়নবিকে এড়িয়ে গেলন। যথেষ্ট অনুসন্ধানের পর বনি সা’ দ গোত্রের হালিমার সন্ধান পাওয়া গেল, যিনি পবিত্র ও সম্ভ্রান্ত বলে পরিগণিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী হারিস বিন আবদুল্লাহ। তিনি হালিমাকে বলেন- ‘ইয়াতিম শিশু মুহাম্মদকে নিতে পার, হতে পারে আল্লাহ তাআলা তার মাঝে আমাদের জন্য কোনো কল্যাণ রেখেছেন।’ অবশেষে হালিমাকেই মহানবীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে নির্বাচন করা হলো।
আর এরপরই হযরত হালিমার পরিবারে শুরু হয় প্রাচুর্য আর বরকতের সব অলৌকক ঘটনাবলী।
এ সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত হালিমা জানান, তাঁরা যখন শিশুর খোজে মক্কায় গিয়েছিলেন তখন তাঁদের বাহন ছিল দুর্বল, পথ চলতে পারত না। কিন্তু মক্কা থেকে ফেরার পথে শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে কোলে নিয়ে যখন দুর্বল বাহনটিতে চলতে লাগলেন, মুহাম্মদ (সা.)-এর বরকতে তা এখন এমন গতিতে চলতে লাগল যে, তা থামতেই কষ্টকর হয়ে গেল। তাঁর সাথী মহিলারা আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগল, ‘এটা কি সেই দুর্বল সাওয়ারী যার ওপর আরোহণ করে তোমরা প্রথম এসেছিলে?’
হালিমার স্তনে একটি শিশুর ক্ষুধা নিবারণ ও তৃপ্তি প্রদান করার মত দুধও থাকত না। তাঁর ছেলে ক্ষুধায় সর্বদা কাঁদত। কিন্তু রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পবিত্র মুখ স্তনে রাখার পর প্রচুর পরিমাণে দুধ হালিমার স্তনে আসতে লাগলো।
বনি সা’ দ গোত্র দীর্ঘ দিন যাবৎ দুর্ভিক্ষে ভুগছিল। অপরদিকে শুষ্ক প্রান্তর ও মেঘহীন আকাশ তাদের দুর্দশা ও দারিদ্রের মাত্রা বৃদ্ধির কারণ হয়েছিল। কিন্তু যেদিন থেকে মহানবী (সা.) হালিমার গৃহে পদ ধুলি দিলেন, তাঁর সার্বিক উন্নতি ও বরকত পরিলক্ষিত হল এবং অভাব অনটনের মধ্যে যার জীবন কাটত তাঁর জীবনে সমৃদ্ধি দেখা দিল।
হালিমা আরো জানান, বাড়ী আসার পর তাঁরা দেখেন, তাঁদের সকল বকরী দুধে পূর্ণ হয়ে আছে। অথচ কিছুক্ষণ পূর্বে সেগুলো দুধ শূন্য ছিল। তাঁর স্বামী উটনীর দুধ দোহন করলেন। এতো পরিমাণ দুধ নির্গত হলো যে, শিশু মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর দুধ ভাই একান্ত তৃপ্তির সাথেই দুধ পান করে ঘুমিয়ে পড়ল। এবং তাঁরাও তৃপ্তির সাথে তা পান করে সারারাত আরামে কাটান। সেইসাথে উটনীর দিকে চেয়ে দেখতে পা্ন, সেগুলোর স্তন আবার দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পর এটাই ছিল প্রথম রাত্রি, যেদিন তাঁরা শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েন। হালিমার স্বামী তাকে বলেন, ”হালিমা! তুমি খুবই সৌভাগ্যবান শিশু নিয়ে এসেছ।” হালিমা নিজেও তার সাথে একমত পোষণ করেন।
এরপর থেকে প্রতিদিন তাঁদের বকরিগুলোর স্তন দুধে টইটম্বুর হয়ে থাকতো, আর অন্যরা তাদের পশুগুলো হতে এক ফোঁটা দুধও সংগ্রহ করতে পারছিলো না।
শিশু নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শৈশবের আরেকটি ঘটনা অত্যন্ত বিষ্ময়কর এবং মানবতার জন্য শিক্ষণীয়। তিনি কখনও হালিমা রা. এর উভয় স্তন থেকে দুধ পান করতেন না। সব সময় একটি স্তন থেকেই দুধ পান করতেন। অপরটি তাঁর দুধভাই আব্দুল্লাহর জন্য রেখে দিতেন। ন্যায়বোধে ও ইনসাফ কায়েমের এমন উত্তম দৃষ্টান্ত তিনি শৈশবেই মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সত্যই এটা একজন মহামানবের পক্ষেই সম্ভব।
এছাড়াও হযরত হালিমা বর্ণনা করেছেন, তিনি কখনও শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে উলঙ্গ অবস্থায় রাখতে পারতেন না। এরূপ করলেই তিনি চিৎকার করে কাটাতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তার শরীরের উপর চাদর টেনে দেয়া না হতো ততক্ষণ তিনি কান্না থামাতেন না। রাসূল (সা.) অতি শৈশবকাল থেকেই একান্তভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতেন।
দুধবোন শায়মার সঙ্গেও মুহাম্মদ (সা.) এর একটি আশ্চর্যজনক ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়। শায়মা বকরি চরানোর সময় সবসময় শিশু মুহাম্মদ কে সঙ্গে নিয়ে মাঠে যেতেন। এটা নিয়ে মা হালিমা তাকে বলেন, সে কেনো শুধু শুধু এতগুলোর বকরির সঙ্গে শিশু মুহাম্মদ কে কষ্ট করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন! এর উত্তরে শায়মা জানান, মুহাম্মদ কে সঙ্গে নিলে তার কোনো কষ্ট হয়না। বরং মুহাম্মদ সাথে থাকলে বকরিগুলো কোনো রকম বিশৃঙখলা ছাড়াই চরে বেড়ায় এবং সন্ধ্যা হওয়ার আগেই তার নিকট ফিরে আসে।
আল্লাহ তাআলা একান্ত রহমত ও বরকত দ্বারা হালিমার ঘরকে সাহায্য করেন। ক্ষুধা ও ভয় থেকে প্রিয়নবিসহ বিবি হালিমার পুরো পরিবারকে হেফাজত করেন। আর এভাবেই নিরাপদে বিবি হালিমার ঘরে বেড়ে ওঠেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।