পদ্মা বহুমুখী সেতুর জানা-অজানা যত তথ্য

আগামী ২৫ জুন অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে বহু প্রতীক্ষিত গর্বের পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধন করতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ব্রাজিলের আমাজন নদীর পর বিশ্বে খরস্রোতা নদীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে প্রমত্তা পদ্মা। সেই পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এই স্বপ্নের সেতু। পদ্মার প্রবল স্রোত উপেক্ষা করে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের দীর্ঘতম এই সেতু। এখন নদীর উভয় তীরে দাঁড়ালেই দেখা যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশি, বিদেশি ও নদীর নিজস্ব (গভীরতা-খরস্রোত) হাজারো প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের পারাপারের জন্য উন্মোচিত হবে নবদিগন্তের দুয়ার। এখন সেই অপেক্ষায়ই প্রহর গুনছে দেশের মানুষ।
সেতুর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই এই সেতু নিয়ে আলোচনা সমালোচনার শেষ নেই। হবেই বা না কেনো! গুনগত মানের দিক দিয়ে বিশ্বের বহু আলোচিত সেতুকেও ছাড়িয়ে গেছে পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। এজন্য এই অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের কাছে তাদের দাবি বাস্তবায়নের কথা জানিয়ে এসেছে। অবশেষে এই সেতুর সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় এনে ১৯৯৮ সালে, প্রথম সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমীক্ষা যাচাইয়ের পর ২০০১ সালে, এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কিন্তু অর্থের জোগান না হওয়ায় সেতুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। পরবর্তীতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। ওই বছরেই তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প পাস করে। পরে ২০১১ সালে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এই সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করে এবং প্রকল্পের সংশােধিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এরপর ২০১৬, সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় দ্বিতীয়বারের মতাে সংশােধন করা হয়। সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারিত হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। প্রথম দিকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, আইডিবি এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার কথা থাকলেও, ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মূল সেতুর কাজ দেওয়া হয় চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড কে।
দ্বিতল পদ্মা সেতু দিয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করতে পারবেন সহজেই। উপর দিয়ে চলবে যানবাহন এবং নিচে চলবে ট্রেন। এই সেতুর রেল সংযােগ প্রকল্পে ১৪টি নতুন স্টেশন নির্মাণ এবং ৬টি বিদ্যমান স্টেশন উন্নয়ন ও অবকাঠামাে নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন ১৪টি স্টেশন হলােঃ কেরানীগঞ্জ, নিমতলা, শ্রীনগর, মাওয়া, জাজিরা, শিবচর, ভাঙ্গা জংশন, নগরকান্দা, মুকসুদপুর, মহেশপুর, লােহাগড়া, নড়াইল, জামদিয়া ও পদ্ম বিল। এছাড়া অবকাঠামাে উন্নয়নের ৬টি স্টেশন হলােঃ ঢাকা, গেণ্ডারিয়া, ভাঙ্গা, কাশিয়ানী, রূপদিয়া ও সিঙ্গিয়া। পূর্বে ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু ও হার্ডিঞ্জ সেতু হয়ে রেলপথে খুলনা যেতে প্রায় ১২ ঘণ্টা লাগত। এখন পদ্মা রেল সেতু দিয়ে সময় লাগবে মাত্র ৪ ঘণ্টা। এতে মোংলা বন্দরের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ সহজ ও সাশ্রয়ী হবে।
বিশ্বে পদ্মা সেতুর চেয়ে দীর্ঘ অনেক সেতু আছে। তবে কিছু কারিগরি দিক থেকে এটি অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। প্রথমত, এটি একই সঙ্গে সড়ক ও রেল সেতু। এতে বিশ্বের গভীরতম (১২২ মিটার) পাইল ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে এতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। একেকটি বেয়ারিং এর ওজন ১০ হাজার ৫০০ টন। রিকটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও সেটি সামলে নিতে পারবে এ বিয়ারিংগুলো। পৃথিবীতে এর আগে এমন বড় বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি কোনো সেতুতে। তৃতীয়ত, বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নদীশাসন–ব্যবস্থা এই প্রকল্পে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ৩ হাজার ৬০০ টন উত্তোলন ক্ষমতার বৃহৎ ভাসমান ক্রেন ব্যবহার করে স্টিলের স্প্যান বসানো হয়েছে। শুধু এই প্রকল্পের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার জার্মানি থেকে বানিয়ে আনা হয়েছে। এসব কারণে সারা বিশ্বের প্রকৌশলীদের মধ্যে এই সেতুর একটা বিশেষ অবস্থান আছে।
সােনালি রং সূর্যের তাপ কম শােষণ করে বলে পদ্মা সেতুর রং করা হয়েছে সােনালি। এই সেতুর মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি। এর মধ্যে নদীর মধ্যে ৪০টি ও নদীর দুই পাড়ে ২টি। নদীর ভেতরের ৪০টি পিলারে ৬টি করে মােট ২৪০টি পাইল রয়েছে। একটি থেকে আরেকটি পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। এছাড়া সংযােগ সেতুর দুই পাশের দুটি পিলারে ১২টি করে মােট ২৪টি পাইল রয়েছে। এই দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা স্প্যান জোড়া দিয়েই সেতু নির্মিত হয়েছে। ৪১টি স্প্যান বসানো দেশের দীর্ঘতম এ সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার। এই সেতুর প্রতিটি স্প্যান ১৫০ মিটার লম্বা।
বর্ষাকালে যখন অতিরিক্ত স্রোত থাকে, এই পদ্মার তলদেশের বালির মতো মাটি ধুয়ে চলে যায় এবং প্রায় ৬৫ মিটার গর্ত হয়ে যায়। যা ২১ তলা বিল্ডিংয়ের সমান উচ্চতার সমান। পদ্মার এই প্রায় ২১ তলার সমান মাটি ধুয়ে চলে যাবার রেকর্ড বা এত বেশি পরিমাণ সেডিমেন্ট (মাটির কণা) ট্রান্সপোর্ট করার রেকর্ড অন্য কোনো নদীর নেই। এ অবস্থায় পানির নিচে মাটি পেতে হলে, নিচে নামতে হবে ৩৪ তলা! তাই সেতুর যে কলামগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলোকে ১২২ মিটারের বেশি লম্বা করেই দিতে হয়েছে। যা প্রায় ৪০ তলা বিল্ডিংয়ের চেয়ে লম্বা কলাম!
এই সেতুর পাইলগুলো গোল। গোল ৪০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান লম্বা সিলিন্ডার! এ সিলিন্ডারের ব্যাস হলো ৩ মিটার। প্রায় ২০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান লম্বা একটার সঙ্গে আর একটা ২০ তলার সমান লম্বা পাইল জোড়া দিয়ে বানানো হয়েছে একটা পাইল! মাটি ১২০-১২২ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো একটি রেকর্ড। পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনো সেতুতে পাইল এত গভীরে প্রবেশ করাতে হয়নি।
যদিও চীনের নানজিং ইয়াংজি সেতু (১৯৬৮ সাল), জাপানের সেতো সেতু (১৯৮৮ সাল), ভারতের বগীবিল সেতুসহ (২০১৮ সাল) উন্নত দেশগুলোতে আগে থেকেই এমন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। তবে পদ্মা নদীর গতিপ্রকৃতি ও বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এখানে যেকোনো সেতু নির্মাণ অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল।
ধারনা করা হচ্ছে, ভূমিকম্প, মাটির ক্ষয়সহ যে কোনো আঘাত প্রতিরোধ করে ঠিকে থাকবে পদ্মা সেতু। এই সেতুর স্থায়িত্ব হবে ১০০ বছর। সব ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে দীর্ঘদিন টিকে থাকার শক্তি রয়েছে পদ্মা সেতুর। আর সেই সক্ষমতা গড়ে তোলার উপযোগী করেই নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা সেতুর অবকাঠামো। দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম এই অবকাঠামো গড়তে ছিল বেশকিছু চ্যালেঞ্জ। প্রকৌশলগত সব চ্যালেঞ্জ জয় করেই শেষ পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে এই সেতু। এখন শুধু দেখার অপেক্ষা।