খাবি লামেঃ টিকটকের নির্বাক এক জাদুবাবা!

এ যেন টিকটকের মুশকিল আসান এক জাদুবাবা। সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে তার কাছে। বড় বড় তারকা যেখানে ভিডিও বানানোর জন্য হাই-কোয়ালিটির ক্যামেরা, অনেক মিউজিক ব্যবহার করেন, লাইটিং নিয়ে খুব সচেতন থাকেন, সেখানে এসবের কিছুই করেন না তিনি। ভিডিওগুলোতে কোন শব্দ থাকে না বলে অন্য যেকোনো ভিডিওর তুলনায় সেগুলোকে দেখলে বেশি বাস্তব মনে হয়। কোনো ধরনের নাচ, গান বা কথা না বলে শুধু ক্যামেরার সামনে বসে থাকেন এই টিকটকার।
বলছিলাম সম্প্রতি তুমুল আলোচনায় থাকা টিকটকার খাবি লামের কথা।
খাবি লামে মূলত একজন সেনেগালিজ-ইতালিয়ান। তার আসল নাম খাবানে লামে। ২০০০ সালের ৯ মার্চে, আফ্রিকার সেনেগালে তার জন্ম। তার বয়স যখন মাত্র ১ বছর, তখন তিনি সপরিবারে ইতালির শিভাসো শহরের পাবলিক হাউজিং কমপ্লেক্সে চলে আসেন। ফুটবল ও বাস্কেটবল তার প্রিয় খেলা। হাইস্কুলে জুনিয়র লেভেলে বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলেছেন তিনি।
টিকটকে যুক্ত হওয়ার আগে খাবি উত্তর ইতালির তুরিনের কাছে একটি ফ্যাক্টরিতে সিএনসি মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২০ সালে মার্চ মাসে, ইতালিতে কোভিড ১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে তিনি চাকরি হারান। এরপর শিভাসোতে বাবা-মা ও তিন ভাই-বোনের সঙ্গে আয় উপার্জনহীন বেকার জীবন কাটাতে বাধ্য হন। তখন বেশ অর্থকষ্টে দিন কাটাতে হয়েছে খাবিকে। কোনো কাজ না থাকায় সময় কাটানোর জন্য মার্চ মাস থেকে খাবি লামে নামে টিকটকে ভিডিও বানানো শুরু করেন। বাবা বারংবার নতুন কাজের খোঁজ করতে বললেও খাবানে পড়ে রইলেন টিকটক নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে একেকটা ছোট্ট ভিডিও বানিয়ে টিকটকে পোস্ট করা শুরু করেন ‘খাবি লামে’ নামে। এই ভিডিওগুলোই আজ খাবিকে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা টিকটকার হিসেবে তৈরি করেছে।
গত বছরের শুরুতে তার লাইফ হ্যাক ভিডিওগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব হয়ে যায়। বেকার খাবান লামে এখন ফুলটাইম টিকটকার। বড় তারকা।
জটিলভাবে দেখানো ভিডিওগুলোকে সহজ পদ্ধতিতে দেখানো শেষে অদ্ভুত অভিব্যক্তি ও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় খাবির চেহারায়। ক্যামেরার দিকে তার এমন অদ্ভুত অভিব্যক্তি নিয়ে তাকানোই ভেঙে দেয় টিকটকের সব রেকর্ড। ক্যামেরার সামনে তিনি নাচেন না, গান গান না, এমনকি কথাও বলেন না। তবু শুধু অভিব্যক্তি দিয়েই খাবি বর্তমানে সেরা টিকটকারদের একজন।
নিজের চেহারার অভিব্যক্তিই যে মানুষকে হাসায় সেটা খাবি নিজেও স্বীকার করেন। তার মতে, এই অভিব্যক্তি বর্তমানে ‘বৈশ্বিক ভাষা’ হয়ে উঠেছে। কারণ, কোনো কথা না বলেও তিনি তার মনের ভাব সবার সামনে তুলে ধরতে পারছেন।
তবে তা মিথ্যে কিছু বলেননি তিনি, ঠিকই বলেছেন।
অন্যান্য টিকটক তারকাদের ভিডিওগুলো যেমন সুসম্পাদিত, খাবি লামের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটা নয়। এদিকে আবার নকল অনুসারী কিনতেও পয়সা-কড়ি খরচ করেননি। তার শীর্ষ অভিমুখে এগিয়ে যাওয়ার কৌশলটা পুরোটাই অরগানিক।
খাবি লামের ভাষায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সফলতা পাওয়ার মূলমন্ত্র হলো ”ধৈর্য্য। প্রায় প্রতিদিনই খাবি লামে নতুন নতুন ভিডিও নিয়ে হাজির হন টিকটকে ও ইনস্টাগ্রামে।
তবে, শুরুর দিকে তার ভিডিওগুলো অবশ্য নির্বাক ছিল না। ইতালীয় ভাষায় তৈরি করা ভিডিওগুলোয় ইতালীয় সাবটাইটেলই যোগ করতেন। কিন্তু সেগুলোয় নয়, বরং নির্বাক ভিডিও দিয়েই পৌঁছান অধিক মানুষের কাছে।
এরমধ্যেই তারকা এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নজরেও আসতে শুরু করেছেন খাবি লামে। দিন কয়েক আগে ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গকে খাবি লামের একটি ইনস্টাগ্রাম ভিডিওতে কমেন্ট করতে দেখা গিয়েছে। ১৯ মে, খাবিকে তার প্রিয় জুভেন্তাস টিমের খেলোয়াড় আলেসান্দ্রো ডেল পিয়েরোর সঙ্গে দেখা গিয়েছে।
খাবিকে নিয়ে বেশ কিছু ফ্যান পেজ আছে। সেগুলো ইংরেজি, জার্মান, অ্যারাবিক, পর্তুগিজ, স্প্যানিশসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় পরিচালিত হয়। কিং বিচসহ বেশ কয়েকজন সুপরিচিত ইউটিউবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে চেয়েছেন। টিকটকের মাধ্যমে আয়ের জন্য তার সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অফার আসছে। কথা হয়েছে বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের সঙ্গেও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইতালিয়ান পাস্তা ব্যারিলা ব্র্যান্ড। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, একটি ম্যাগাজিনের জন্য মডেলিংয়ের কাজ করেছেন তিনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক তারকা হয়ে উঠেছেন খাবি। তাকে ঘিরে বাড়ছে কাজের চাহিদাও।
বর্তমানে তার ফলোয়ার সংখ্যা ২০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। বারিলা ছাড়াও নেটফ্লিক্স এবং ভারতীয় ফ্যান্টাসি স্পোর্টস প্ল্যাটফর্ম ড্রিম ২-সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন লামে। টিকটকে নতুন হওয়ায় এখনো খাবির নির্দিষ্ট আয় কত তা জানা যায়নি। তবে তার অর্থের পরিমাণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। মার্কেটিং হাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, খাবি প্রতি টিকটক পোস্টের জন্য ৯৮,৫৬১ ডলার থেকে শুরু করে ১,৪৭,৮৪২ ডলার চার্জ করছেন। অনেকের মতে, খাবির অর্থের পরিমাণ ১-২ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। তাকে স্পনসর করা একেকটি পোস্টের মূল্য ১৩,৩৮০ ডলার থেকে ২২,৩০০ ডলারের মধ্যে।
২০২০ সালের অক্টোবরে, জাইরা নুচ্চির সঙ্গে তার বাগদানের ঘোষণা করেছিলেন খাবি।
প্রসঙ্গত, সোশ্যাল মিডিয়ায় খাবি এতটাই ভাইরাল হয়েছেন যে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই তাকে ফলো করা হয়। বর্তমানে তার একজন ম্যানেজার আছে। যিনি খাবিকে আন্তর্জাতিক স্টার বানাতে কাজ করছেন।
কারখানায় শ্রমিকের কাজ হারিয়ে টিকটকে ভিডিও তৈরি বেছে নিয়েছিলেন খাবি লামে। আর এখন এটাই তার পূর্ণকালীন কাজে পরিণত হয়েছে।