সত্যের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে খুন হলেন আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ!

ফের জীবন দিয়ে সাংবাদিকতার মূল্য চোকালেন এক সাংবাদিক। ইজরাইল সংলগ্ন অধিকৃত গাজা এলাকার জেনিন শহরে ইজরাইল সেনাদের গুলিতে আল জাজিরার একজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। নিহত ওই সাংবাদিকের নাম ‘ শিরীন আবু আকলেহ’। তিনি আল জাজিরার দায়িত্বে নিয়োজিত হয়ে জেনিনে ইজরাইলি আগ্রাসনের খবর সংগ্রহে সেখানে গিয়েছিলেন। গত ১১ মে, বুধবার এ তথ্য জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ আরব বিশ্বের এক সুপরিচিত নাম। ৫১ বছর বয়সি আকলেহ আল জাজিরার আরবি বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক ছিলেন৷ ওই অঞ্চল এবং পৃথিবীর অন্যত্রও তার শান্ত ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্বকে সবাই সমীহ করতো। ১৯৯৭ সালে, তিনি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় যোগ দেন। ঘর-বাড়ি, মাঠ-ঘাট, ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলোতে তার উপস্থিতি নতুন সংবাদ সংস্থা আল-জাজিরা নেটওয়ার্ককে ২৪ ঘণ্টার আরবি ভাষায় প্রচারিত চ্যানেলে রুপান্তরিত করে। ২০০০ সালে, ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার শুরু থেকে তিনি আল-জাজিরার সঙ্গে কাজ করছিলেন। আরব বিশ্বের বর্তমান প্রজন্মের যে নারীরা সাংবাদিকতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তাদের প্রেরণার বাতিঘর ছিলেন শিরিন আবু আকলেহ। তিনিই আরব বিশ্বের প্রথম নারী প্রতিনিধি- যাকে সরাসরি টেলিভিশনে দেখা গেছে।
জানা যায়, জেনিন শহরে ইজরাইলি সেনার অভিযান সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছিলেন আল-জাজিরার আরবি সংবাদ চ্যানেলের সাংবাদিক শিরিন। ঘটনার সময় ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে খবর সংগ্রহ করছিলেন তিনি। মূলত সেই সময় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নৃশংস সামরিক অভিযান চালাচ্ছিল ইহুদিবাদী ইসরাইল। জানা যায়, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদে নতুন করে লাগাতার সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলের সেনা। এবার জেনিন শহর থেকে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেখানে নতুন করে অবৈধ বসতি গড়ার ছক কষেছে তারা। সেই কারণেই এই শহরে তীব্র আক্রমণ চালাচ্ছে তারা। আর সেই হামলারই শিকার হলেন সাংবাদিক শিরিন।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে খবর অনুযায়ী, খবর সংগ্রহের কাজ করার সময়ই আচমকা গুলিবিদ্ধ হন শিরিন। ঘটনার ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শিরীন আবু আকলেহ’র মাথায় গুলি করা হয়েছে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যুর বিষয় টি নিশ্চিত করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
কাতারের উপ বিদেশমন্ত্রী লোলওয়া আল খাতের সংবাদসংস্থাকে জানিয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় শিরিন আবু আকলেহ প্রেস জ্যাকেট পরা ছিলেন যাতে তাকে স্পষ্টভাবেই সাংবাদিক বলে চেনা যায়! এছাড়াও তার মাথায় ছিল হেলমেট। তাও ইজারাইলি সেনারা তাকে রেহাই দিলো না। কাতারের উপ বিদেশমন্ত্রী এই ঘটনাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে দাবি করেছেন।
ফিলিস্তিনের রামাল্লা থেকে আল-জাজিরার আরেক সাংবাদিক নিদা ইব্রাহিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, শিরীন আবু আকলেহ-র সঙ্গে কাজ করা সাংবাদিকদের জন্য এই ঘটনা একটি বড় ধাক্কা। বুধবারের ঘটনায় আলি সামুদি নামের আরেক ফিলিস্তিনি সাংবাদিকও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তবে জেরুজালেম ভিত্তিক কুদস পত্রিকার এই সংবাদকর্মীর অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সাংবাদিকদের টার্গেট করে গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, বুধবার সকালে তাদের সৈন্যরা এবং নিরাপত্তা বাহিনী জেনিনের শরণার্থী শিবিরে হামলা চালিয়েছিল ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসবাদীদের’ ধরতে। তবে কোন সাংবাদিককে গুলি করা হয়নি বলেই দাবি করা এক ইজরালিয় সেনা আধিকারিক বলেছেন এটা তদন্ত সাপেক্ষ তারা তদন্ত করেই পুরো বিষয়টা বলতে পারবেন।
সেইসাথে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, গোলাগুলি চলার সময় ‘সম্ভবত’ ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীদের গুলি লেগেছিল এদের গায়ে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, ইসরাইলের ছোঁড়া গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে শিরিনের।
আল জাজিরা ইতিমধ্যেই বিশ্বের সমস্ত দেশের কাছে আর্জি জানিয়েছে, ইচ্ছাকৃত ভাবে একজন সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করার জন্য ইজরাইলি সেনাকে যেনো দোষি স্যবস্ত করা হয়। এছাড়াও আল জাজিরা তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ”আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইজরায়েলের সেনা ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে আল জাজিরার করেসপন্ডেন্টকে।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ও মুক্ত-স্বাধীন মানুষরা তাকে একজন ‘শহীদ’ উপাধি দিয়েছেন। পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ইতোমধ্যে তার ছবি সম্বলিত একটি বিলবোর্ড টানানো হয়েছে। তবে সারা জীবন তিনি কেবল একটি উপাধিই পেয়েছেন, আর তা হচ্ছে ‘সাংবাদিক’। এদিকে শিরিন আবু আকলেহ’র শাহাদাতের ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা গেছে। তার ছবি হাতে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু হয়েছে ফিলিস্তিনে।
২০ বছর আগে, ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন রিফিউজি ক্যাম্পে ইসরাইলি বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ প্রচার করে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। সেই একই শহরে ইসরাইলিদের হামলার সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে তিনি নিজেই হয়ে গেলেন সবচেয়ে বড় সংবাদ।
তার নিথর দেহে তখনও সাদা অক্ষরে ‘প্রেস’ বা সাংবাদিক লেখা নীল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটি জড়ানো, হাসপাতালের স্ট্রেচারে তার চারপাশে জড়ো হওয়া বেদনায় জর্জরিত সহকর্মীদের ছবিগুলো দেখে বিশ্বব্যাপী নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কেউ যেন এই সংবাদ বিশ্বাসই করতে পারছে না। তার কাঠের কফিনটি যেন স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে, ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলি হামলার সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে কত সাংবাদিকের রক্ত ঝরলো, জীবন দিলো কত সাংবাদিক!