
জীবনের চেয়ে ক্রিকেট অনেক সহজ। একটা ম্যাচ জেতার চেয়ে জীবনের বাইশ গজে টানা টিকে থাকার সংগ্রাম করাটা খুব কঠিন। তার ওপর যদি ব্রেন টিউমারের মত প্রাণঘাতি অভিশাপ যোগ হয়, তখন ব্যাট করাটা আরো মুশকিল হয়ে যায়। যেমনটা হল ক্রিকেটার মোশাররফ রুবেলের ক্ষেত্রে।
জীবনের সর্বোচ্চটুকু দিয়েই লড়াই শুরু করলেও, শেষ অবধি আর লড়তে পারলেন না। ব্রেইন টিউমারের কাছে হেরে গিয়ে অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বাঁহাতি স্পিনার খন্দকার মোশাররফ হোসেন রুবেল।
১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর, ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন মোশাররফ রুবেল। ক্রীড়াবিদ হিসেবে সুযোগ মেলে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্লু অ্যাওয়ার্ড জেতা রুবেলের ধ্যানজ্ঞানটা অবশ্য ছিল শুধু ক্রিকেটকে ঘিরেই। ক্রিকেট পাড়ায় ভদ্র ক্রিকেটার হিসেবে বেশ সুনাম কাড়েন তিনি। বরাবরই শান্ত প্রকৃতির রুবেলের প্রফেশনাল ক্রিকেটে হাতেখড়ি ২০০১-০২ মৌসুমে।
তখন থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত অংশগ্রহণ ছিলো তার। বাঁহাতি অর্থোডক্স বোলার হিসেবে নিয়ন্ত্রিত বোলিং যেমন ঘোল খাইয়েছেন ব্যাটারদের, তেমনি রান খরচের বেলায় দেখিয়েছেন কিপ্টেমি। ধারাবাহিকভাবে ফর্ম ধরে রাখার কারণে ২০০৮ সালে প্রথমবার সুযোগ পান বাংলাদেশ জাতীয় দলে। তার প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটি ওয়ানডে সিরিজে।
কিন্তু কয়েক মাস পরেই কথিত বিদ্রোহী ক্রিকেটারদের লিগ, ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে যোগ দেয়ায় রুবেল বেশিদিন খেলতে পারেননি জাতীয় দলে। তবে দুই বছর পর আবারও ফিরে আসেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। বোলিংয়ের সেই ধার তখনো হারাননি। তাকে বাদ দিয়ে দল সাজানোটা ছিলো মোটামুটি অসম্ভব। ২০১৩ সালে, বিপিএল ফাইনালে ম্যাচ সেরা হয়ে চ্যাম্পিয়ন করেছেন ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সকে। সেই একই আসরে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ আনা হয় বাঁহাতি এই স্পিনারের ওপর। আইসিসির পক্ষ থেকে ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২ মাসের মাথায়ই সেই কলঙ্ক থেকে মুক্তি পান রুবেল।
আবারও স্বপ্ন বুনেন জাতীয় দলে খেলার। অবশেষে তা সত্যি হয় ২০১৬ সালে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেই সিরিজে ৮ বছর পর আবারও বাংলাদেশের জার্সি গায়ে পরে খেলতে নামেন তিনি। পরের সুযোগটির জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও ২ বছর।
মানুষ হিসেবে মোশাররফ হোসেন রুবেলের বেশ খ্যাতি আছে। নির্ঝঞ্ঝাট, হাসিখুশি ও দারুণ পরিশ্রমী এই ক্রিকেটার কখনোই কোনো বিতর্কের মুখে পড়েননি।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার দেখে রুবেলের ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান বিচার করতে গেলে ভুল হতে পারে। কারণ, এখন পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলাদেশের যে ক’জন ক্রিকেটার নিজেদের সেরাটা দিয়ে খেলে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে রুবেল একজন। বাঁহাতি এই বোলিং অলরাউন্ডার ১১২টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৩৯২ উইকেট। ব্যাটিংয়ে ৩,৩০৫ রান, রয়েছে ২টি সেঞ্চুরি আর ১৬টি হাফ সেঞ্চুরি।
‘লিস্ট এ’ ম্যাচ খেলেছেন ১০৪টি। উইকেট ১২০টি। ব্যাটে ১,৭৯২ রান, ৮টি হাফ সেঞ্চুরি। ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে ৫৬ ম্যাচ খেলে ৬০ উইকেট আর ৬২ রান।
প্রায় তিন বছর ধরে ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত ছিলেন জাতীয় দলের এই বাঁহাতি স্পিনার। ২০১৯ সালে, ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে রুবেলের।
ক্যারিয়ারে শেষবারের মতো বল করেন ২০১৯ বিপিএলে। ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ার আগে শেষবার ২০১৯ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ খেলেছিলেন মোশাররফ রুবেল। মিরপুরে ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে খেলা ওই ম্যাচটাই হয়ে থাকলো রুবেলের শেষ ক্রিকেট স্মৃতি।
যদিও ২০২০ সালে, সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে মাঠে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রুবেল। কিন্তু নভেম্বরে আবার অসুস্থ হন। ২০২১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে, এমআরআই করার পর দেখা গেছে, পুরনো টিউমারটি আবার নতুন করে বাড়তে থাকে।
গত ১৯ এপ্রিল, ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ৪০ বছর বয়সে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
রুবেলরা এভাবেই ক্যারিয়ারের সাথে লড়াই করতে করতে জীবনের সাথে লড়াইটা চালিয়ে যান। কখনো ফিরে আসেন, কখনো হারিয়ে যান।