কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার বাপ্পী লাহিড়ী’র জীবনী

সংগীত জগতে একের পর এক নক্ষত্র পতনে শোকে স্তব্ধ বাংলা সংগীত প্রেমিরা।। গত ৬ ফেব্রুয়ারি, লতা মঙ্গেশকরের পর মঙ্গলবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জীবনাবসান ঘটে। সেই শোক না কাটতেই বাপ্পী লাহিড়ীও পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে।
বাপ্পী লাহিড়ী ১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সমৃদ্ধ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম অলোকেশ লাহিড়ী। তার বাবা অপরেশ লাহিড়ী ও মা বাঁশরী লাহিড়ী। তারা দুজনই ছিলেন গানের জগতের মানুষ। ফলে একমাত্র সন্তান বাপ্পী ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। মা-বাবার কাছেই পান প্রথম গানের তালিম। ভারতীয় চলচ্চিত্রের আরেক প্রবাদ প্রতীম গায়ক, অভিনেতা কিশোর কুমার ছিলেন তার তুতো মামা।
শৈশব থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও শ্যামা সঙ্গীত শুনে বড় হয়েছিলেন বাপ্পী। ৩ বছর বয়সেই তবলায় হাতে খড়ি তার। মাত্র চার বছর বয়সে লতা মঙ্গেশকারের একটি গানের সঙ্গে তবলা বাজিয়ে সকলের নজর কেড়েছিলেন তিনি। তারপর দীর্ঘদিন বাংলা ও হিন্দি ছবির গান গেয়েছেন, সুর দিয়েছেন। তখন থেকেই তার ডাক নাম বাপ্পী বলেই মুম্বাই ফিল্ম জগতের দিকপালরা তাকে ডাকতেন।
চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে বাপ্পী লাহিড়ীর আবির্ভাব মাত্র ১৯ বছর বয়সে। তার রচিত গানগুলো কিশোর কুমার এবং আশা ভোঁসলে’র নৈপথ্য কণ্ঠ সঙ্গীতের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের পর্দায় এসেছে। তার ইচ্ছে ছিল টিনসেল টাউনে একদিন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া। সেই সময়টায় হিন্দি ও বাংলা সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় ও সফল সংগীত পরিচালক ছিলেন বাপ্পী। সিনেমা পাড়ায় সবাই তাকে ভালোবেসে ডাকতেন ‘বাপিদা’।
বাপ্পী লাহিড়ীকে বলা হয় ভারতে ডিস্কো গানের প্রবর্তক। যে কয়েকটি গান তাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল, তার মধ্যে আছে ‘চলতে চলতে’, ‘ডিস্কো ড্যান্সার’, ‘শারাবি’ ইত্যাদি গান।
১৯৭০ এর দশকের শেষভাগেই তখনকার বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তার ক্যারিয়ার তুঙ্গে পৌঁছায় এবং ১৯৮০ এবং ৯০ এর দশকেও তা সমান তালে এগিয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘নান্নাহ শিকারি’ সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন তিনি।
হলিউডের ছবিতেও তার গান বেশ কয়েকবার ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৮১ সালে তৈরি ছবি ‘জ্যোতি’র একটি গান ‘কলিয়োঁ কা চমন’ সেই সময়ে অ্যামেরিকান টপ ৪০ তালিকায় ছিল।
১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া মিঠুন চক্রবর্তী অভিনিত হিন্দি ছায়াছবি ডিস্কো ড্যান্সারের টাইটেল সঙ্গীত ‘আই অ্যাম এ ডিস্কো ড্যান্সার’ গেয়ে তিনি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পান। ডিস্কো ডান্সার’ গানটি সে সময় ভারতীয় উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য দেশেও জনপ্রিয়তা পায়।
বলিউডে গানের ধারায় এক নতুন বদল এনেছিলেন বাপ্পী লাহিড়ি। মুম্বাইয়ে বাঙালি শিল্পীদের একটা বড় জায়গা তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে একাধিক ছবিতে গান পরিচালনা করেছেন বাপ্পী লাহিড়ি। ঊষা উত্থুপের সঙ্গেও একাধিক গান গেয়েছেনষ। বাপ্পী লাহিড়ি একাধিক ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনাও করেছেন। এমনকী গানও লিখতেন তিনি।
একের পর এক সুপারহিট গান উপহার দিয়েছেন ভারতীয় সংগীতের `ডিস্কো কিং’। হিন্দিতে ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘ডান্স ডান্স’, ‘হিম্মতওয়ালা’, ‘চলতে চলতে’, ‘শরাবি’, ‘সত্যমেব জয়তে’, ‘কমান্ডো’, ‘শোলা অউর শবনম’ সিনেমায় তিনি সংগীত পরিচালনা করেছেন। কলকাতার ‘অমর সঙ্গী’, ‘আশা ও ভালবাসা’, ‘আমার তুমি’, ‘অমর প্রেম’ সিনেমার গানেও সুর দিয়েছেন; গেয়েছেন একাধিক গান। ২০২০ সালে ‘বাঘি-৩’ সিনেমার ‘ভাঙ্কাস’ ছিল বলিউডে তাঁর শেষ গান।
তিনি যেমন একদিকে ছিলেন চলচ্চিত্রের নেপথ্য গায়ক, তেমনই ছিলেন সুরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে’ গানটির সুরকার ছিলেন বাপ্পী লাহিড়ী। এই গানটি লিখেছেন গীতিকার শ্যামল গুপ্ত, যিনি সদ্য প্রয়াত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী।
বাপ্পী লাহিড়ী সিনেমার গান করার পাশাপাশি একাধিক রিয়েলিটি শো-র বিচারক ছিলেন।
তার গানের গলা যেমন ছিল জনপ্রিয়, তেমনই গলায়, হাতে প্রচুর সোনার অলঙ্কারও ছিল বাপ্পী লাহিড়ীর পরিচয়ের আরেকটা অঙ্গ। প্রচুর সোনার গয়না পরতে ভালোবাসতেন। ছিল গায়কির নিজস্ব কায়দা, যা তাকে হিন্দি ছবির জগতে অনন্য পরিচিতি দিয়েছিল।
২০১৪ সালে তিনি জানিয়েছিলেন, তার সোনার গয়নার বাজারমূল্য ৪০ লাখ টাকা। তার রুপার গয়নার বাজারমূল্য ছিল দুই লাখ ২০ হাজার টাকা। মোট ২০ কোটি টাকার সম্পত্তি ছিল তার। তবে আট বছরে যে তার গয়না ও সম্পদের পরিমাণ অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল, তা বলাবাহুল্য। বিবিসি লিখেছে, ২০১৬ সালে কিংবদন্তী এই সংগীত পরিচালক বলেছিলেন, সোনার প্রতি তার এই ভালোবাসা আসলে আমেরিকান রকস্টার এলভিস প্রিসলির প্রতি তার ভালোবাসার সঙ্গে জড়িত। এলভিস প্রিসলিও সোনার চেইন পরতেন। এই রকস্টার ও অভিনেতার বড় অনুরাগী ছিলেন ‘ডিস্কো কিং’। তার স্ত্রী চিত্রানী লাহিড়ীও সোনা খুব পছন্দ করেন।
কার নলেজে-২০২১ এর তথ্য অনুযায়ী, বাপ্পি লাহিড়ির মাসিক আয় ২০ লাখ টাকা এবং বাৎসরিক আয় ২ কোটি টাকারও বেশি ছিল৷ সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, প্রতিটি গানের জন্য আট থেকে ১০ লাখ টাকা নিতেন তিনি। এক ঘণ্টার পারফরম্যান্সের জন্য ২০-২৫ লাখ টাকা নিতেন। ভারতের সর্বাধিক করদাতাও ছিলেন তিনি।
বাপ্পী লাহিড়ী ২০০৪ সালে রাজনীতিতে এসেছিলেন। সেবছর তিনি কংগ্রেসের হয়ে প্রচার চালিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ভারতে শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সেবছরের লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর কেন্দ্র থেকে বিজেপির হয়ে ভোটেও লড়েছিলেন বাপ্পী লাহিড়ী। নিজেই বলেছিলেন যে, সেই সময়ে নরেন্দ্র মোদির ঢেউ চলছিল ভারতে। কিন্তু তিনি ভোটে হেরে যান।
কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার বাপ্পী লাহিড়ী ২০২১ খ্রিস্টাব্দে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থতার কারণে গত একমাস তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তবে সেরে উঠে সোমবার বাড়ি ফেরেন তিনি। মঙ্গলবার রাতে আবারও অসুস্থ বোধ করায় চিকিৎসককে বাড়িতেই ডেকে আনা হয়েছিল। ফের তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবশেষে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাত্রি ১১টা ৪৫ মিনিটে, ৬৯ বৎসর বয়সে মুম্বাইয়ের হাসপাতালে অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণে পরলোক গমন করেন তিনি।