দুই মাথা, এক শরীর নিয়ে দুই বোনের বিস্ময়কর জীবন!

সংযুক্ত জমজ সম্পর্কে কমবেশি সবার ই জানা আছে। পৃথিবীতে প্রতি ৫০ হাজারের মধ্যে ১ জন এমনভাবে জন্মাতে পারে। এদের মধ্যে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ সংযুক্তারা বাঁচলেও অন্তত ৩৫ শতাংশই জন্মের পরপরই মারা যায়।
তেমনি এক সংযুক্ত জমজ জার্মানির নাগরিক অ্যাবিগেইল এবং ব্রিটনি। ডাইসফ্যালিক প্যারাপ্যাগাস যমজ হিসেবে বিবেচিত এই দুই বোন। তাদের মতো সংযুক্ত জমজদের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী অনেক কমই আছেন। দুজনে একই শরীরে যুক্ত থাকলেও তারা সম্পূর্ণ দুটো আলাদা মানুষ। এমনকি তাদের আলাদা চিন্তাভাবনা, নেশা, খাদ্যাভ্যাস। তাদের মাথা ও ঘাড় আলাদা। দুই পায়ে ভর করে চলেন তারা। এমনকি তাদের হাতও দুটি।
১৯৯০ সালের ৭ মার্চ, জার্মানির মিনেসোটায় জন্ম নেয় অ্যাবিগেইল লরেন হেনসেল এবং ব্রিটনি লি হেনসেল। বর্তমানে তাদের বয়স ৩১ বছর। অ্যাবির উচ্চতা ৫’২” এবং ব্রিটনির উচ্চতা ৪’১০”।
অ্যাবিগেইল আর ব্রিটনির জন্ম ই শুরু হয় এক করুণ অধ্যায় দিয়ে। তাদের মা প্যাটি হেনসেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর জানতেন পারেন তার শরীরে একটি ভ্রূণই বেড়ে উঠছে। কিন্তু চিকিৎসকেরা তাকে যমজ সন্তান উপহার দেন। কিন্তু তার এ জমজ সন্তান অন্যান্য সাধারণ জমজদের মত ছিলো না। দুটো শিশুই জোড়া লাগানো ছিল। শুধু বাইরে থেকে তাদের মাথা দুটো আলাদা। সাধারণত এ রকম সন্তান খুব বেশি দিন বাঁচতে পারে না।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, অস্ত্রোপচার করে তাদের আলাদা করে দেয়া যাবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে যে কোনো একজনকে বাঁচানো সম্ভব হবে। সম্ভবত পৃথিবীর যে কোনো মায়ের জন্য সবচেয়ে নিষ্ঠুর শর্ত গুলোর একটি দেওয়া হলে তাকে। কিন্তু কোনো সন্তানকেই হারাতে রাজি ছিলেন না প্যাটি। তাই অস্ত্রোপচার করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। অবশেষে স্বামীর সঙ্গে মিনেসোটার প্রত্যন্ত ফার্মে দুই সন্তানকে বড় করতে থাকেন প্যাটি।
সমাজের সঙ্গে সংগ্রাম করে, নিজেদের সঙ্গে সংগ্রাম করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তারা। একজন সাধারণ মানুষের মতই মেয়েদের বড় করেছেন হেনসেল দম্পতি। অ্যাবি অংক এবং ব্রিটনি ইংরাজিতে স্নাতক অর্জন করেছে। দৌড়, সাতার এবং অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ ও সহজ ভাবে করেন তারা। শুধু তাই নয়, দুজনেরই আলাদা ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। এই মুহূর্তে দু’জনেই স্কুল শিক্ষিকা।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, দুজনের শরীর এক হলেও মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ আলাদা। তাই তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চিন্তাভাবনাও আলাদা। এমনকি খাবারের প্রতি ভালবাসাও আলাদা। তাদের মাথা, ঘাড়, হৃৎপিণ্ড, পিত্তথলি এবং পাকস্থলী আলাদা। তাই খিদেও আলাদা আলাদা সময়ে পায়। এমনকি তারা বিয়েও করতে চায় দুজন আলাদা মানুষ কে।
অন্যদিকে তাদের ফুসফুস তিনটি। সেইসঙ্গে দুইটি কিডনি ও একটি করে লিভার, জরায়ু, ডিম্বশয়, যৌনাঙ্গ ও মূত্রাশয় আছে এই জমজদের। তিনটি হাত নিয়ে জন্মেছিলেন তারা। তবে তিন নাম্বার হাতটি তারা সেভাবে ব্যবহার করতে পারত না। এজন্যই তা পরবর্তীতে কেটে অপসারণ করেন চিকিৎসক।
একটা শরীর নিয়ে কী ভাবে তাঁরা দুটো আলাদা মানুষের পরিচয় বহন করলেন? দুটো আলাদা ব্রেন কী ভাবে দুটো হাত এবং পা-কে আলাদা আলাদা সিগন্যাল পাঠায়? আর কী ভাবেই বা সেই আলাদা সিগন্যালে সাড়া দেয় এই দুই হাত-পা, তা আজও গবেষকদের কাছে এক চরম বিস্ময়! আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হল, একজনের জ্বর হলেই যে অন্যজনের জ্বর হবে তা কিন্তু নয়। দু’জনের শরীর এক হলেও অসুখ-বিসুখ বেশির ভাগ সময়ই একসঙ্গে হয় না!
এত অপূর্ণতায় জন্ম নিয়েও অ্যাবি আর ব্রিটনি এই নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। নিজেদের মধ্যে তাঁদের দারুণ বোঝাপড়া। দুজনের উচ্চতা সমান না হওয়ার চলাফেরা করতে একটু অসুবিধা হয়। কিন্তু এই জীবনের সাথে মানিয়ে নিয়েছে তারা।
তবে সে সবের মধ্যে তাঁদের একটাই আফসোস। যে স্কুলে তাঁরা পড়ান, সেখানে তাঁদের একজন হিসাবেই গণ্য করা হয়। তাই বেতনও একজনেরই দেওয়া হয়। অথচ শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বিগুণ পরিশ্রম করেন তাঁরা। অ্যাবি অংক পড়ায় আর ব্রিটনি ইংরেজি।