ফেসবুক মেটাভার্সঃ ইন্টারনেটের ভবিষ্যত

মেটাভার্স শব্দটি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সাই ফাই লেখক নিল স্টিফেনসন, ১৯৯২ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘স্নো ক্র্যাশ’ এ। তখন কে জানতো প্রায় ৩০ বছর এই শব্দটি টেক বিশেষজ্ঞদের কাছে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। কিন্তু কি এই মেটাভার্স?

মেটাভার্স মূলত ভার্চুয়াল রিয়েলটির একটি উন্নত সংস্করণ। দীর্ঘদিন ধরেই টেক দুনিয়ায় আলোচনা হচ্ছিল ফেসবুক ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে নতুন রূপে পৃথিবীর সামনে আনতে যাচ্ছে। অবশ্য ফেসবুক কিংবা জাকারবার্গ একা নন। বেশ কিছু বড় কর্পোরেশন একই সাথে এই প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো, মাইক্রোসফটের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া। তবে জাকারবার্গ ও ফেসবুকই প্রথমবারের মত ব্যবহারের উপযোগী একটি ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি প্রোগ্রাম সামনে নিয়ে এলেন। কি থাকছে এই এই মেটাভার্সে? এটি মূলত একটি সম্পূর্ণ নতুন দুনিয়া। যেখানে অগুমেন্টেড রিয়্যালিটি, ভিডিও কলিং, হলোগ্রামের থ্রি-ডি অবতার, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি এক হয়ে গেছে। ব্যবহারকারীরা নিজের ঘরে হাঁটলে, কথা বললে ভার্চুয়াল জগতের অ্যাভাটারও হাঁটবে, কথা বলবে। এটি এমন এক সাইবার জগৎ, যেখানে ভার্চুয়াল রিয়েলেটির মধ্যেই গেমিং, ব্যবসায়িক মিটিং এবং সব কাজ করা যাবে। এমনকি এর মাধ্যমে বন্ধুরা একসাথে দেখা সাক্ষাৎ কিংবা কনসার্টে অংশগ্রহণ সবই সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এটিই ইন্টারনেটের ভবিষ্যত হতে যাচ্ছে। করোনা পরবর্তী বিশ্বে যেখানে স্পর্শবিহীন সম্পর্কের দিকে জোর দেয়া হচ্ছে সেখানে এই প্রযুক্তির আর্বিভাব নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।

মেটাভার্স তৈরির বেশ কিছু আগেই, এক সাক্ষাৎকারে জাকারবার্গ জানান, তিনি এমন এক ইন্টারনেট ব্যবস্থা তৈরি করবেন, যেখানে ব্যবহারকারী কনটেন্ট দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে থাকবেন, অনুভব করতে পারবেন। এ অনুভূতি দ্বিমাত্রিক অ্যাপ বা ওয়েবপেজে সম্ভব নয়।ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইনফিনিট অফিস তৈরির কাজে হাত দিয়েছে ফেসবুক। সেখানে ব্যবহারকারী নিজের পছন্দমতো পরিবেশে কাজ করতে পারবেন। মার্ক জানান, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কেবল মোবাইলে যোগাযোগ করার বদলে এক ব্যবহারকারী অন্য ব্যবহারকারীর পাশে গিয়ে বসতে পারবেন। বেশ কয়েক মাস আগে নিজেদের জন্য অকুলাস ভিআর চালিত মিটিং সফটওয়্যার, হরাইজন ওয়ার্করুমস বের করে ফেসবুক। এই অকুলাস অবশ্য ফেসবুকের নিজের প্রতিষ্ঠা করা কিছু নয়। এটি একটি ভিআর প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যা ফেসবুক নিজে ২০১৪ সালে কিনে নেয়। এই অকুলাসই ২০১৯ সালে ফেসবুকের হরাইজন সেবা তৈরি করে দেয়। এছাড়া অকুলাসের ভিআর হেডসেট ব্যবহার করে নিজের এভাটার ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ওয়ার্কপ্লেসে প্রবেশ করা যাবে। তবে কিভাভে এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো একে অপরে সাথে যুক্ত হবে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সেই সমাধান বের করতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে বেশ কয়েকটি ভি আর প্রযুক্তি একসাথে জুড়ে দিয়ে মেটাভার্স বানাতে যাচ্ছে ফেসবুক। মেটা অবশ্য ফেসবুকের নতুন নামও । নানা কারণেই ফেসবুক তার নাম বদলে ফেলতে চাচ্ছিল। নতুন ‘মেটা’ কোম্পানির আওতায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইন্সটাগ্রামকে নিয়ে আসা হয়েছে। কোম্পানির নতুন নাম ঘোষণার একই লাইভ-স্ট্রিম ইভেন্টে মেটাভার্সে থাকা নিজের একটি এভেটার এর সাথে কথা বলেন মার্ক জাকারবার্গ। এদিকে মেটাভার্স কন্সেপ্টের স্রষ্টা নিল স্টিফেনসনকে চীফ ফিউচারিস্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ভিআর নিয়ে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ম্যাজিক লিপ।

তবে ফেসবুকের এই নাম পরিবর্তন আর মেটাভার্সের আবিষ্কারকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন। বিশেষত মার্কিন আইন প্রণেতারা বিভিন্ন কারণে ফেসবুকের উপর বিরক্ত ছিলেন। অধিকাংশ আইন প্রণেতার বক্তব্য হলো, ফেসবুক দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকদের তথ্য বিক্রি করে ব্যবসা করে আসছিল। ফেসবুকে পরিবর্তন দরকার এ সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক উভয় দলের সিনেটররা একমত হয়েছেন। বিশেষ ক্যামব্রিজ এনালিটিকা কেলেংকারির পর ফেসবুকের এসব তথ্য বাইরে বেরিয়ে আসে। নিজেদের দুর্নাম কমাতেই ফেসবুক ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে নাম বদল করেছে বলে অনেকে মনে করছেন। অবশ্য মার্কিন সিলিকন ভ্যালির টেক কোম্পানিগুলোর নাম পরিবর্তনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কোম্পানি সমালোচিত, বিতর্কিত কিংবা আর্থিক সমস্যায় পড়লে নাম পরিবর্তন করে থাকে। এর আগে ২০১৫ সালে মার্কিন টেক জায়ান্ট গুগল মূল কোম্পানির নাম ‘অ্যালফাবেট রাখে। কোম্পানিগুলো তাদের নেতিবাচক বিষয়কে আড়ালে করতে সেবার মান বাড়ানোর নামে নাম পরিবর্তন করে থাকে। এটা এক ধরনের মার্কেটিং কৌশল। ফেসবুকের ক্ষেত্রেও এই কারণগুলো আছে।গত ২৭ অক্টোবর কানাডাভিত্তিক প্রযুক্তিবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট তাদের রিপোর্টে বলেছে, ফেসবুক তার নাম পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্রান্ডটির কেলেঙ্কারি ও নেতিবাচক প্রভাব। যার জড়িত ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। সাম্প্রতিক কেলেংকারি ও হুইসেল ব্লোয়িং এর আগে থেকেই ফেসবুক এই সময়ের সবচেয়ে কম বিশ্বস্ত প্রযুক্তি সংস্থা ছিল। জাকারবার্গ একসময় সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে প্রশংসিত সিইও ছিলেন। কিন্তু ফেসবুকের নানা কেলেঙ্কারির পর থেকে তার প্রভাব কমেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে এখন তিনি তা ফিরিয়ে আনতে চাইছেন।
ফেসবুকের সাবেক প্রোডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সেস হাউগেন প্রতিষ্ঠানটির অনেক গোপন নথি প্রকাশ করে দিয়েছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা এ নিয়ে ধারাবাহিক রিপোর্ট করেছে। সম্প্রতি ক্যাপিটাল হিলে সিনেট কমিটির সামনে শুনানিতে ফেসবুকের ব্যাপক সমালোচনা করেন তিনি। সিনেটে দেয়া সাক্ষীতে হাউগেন বলেন, ফেসবুক এবং তাদের অ্যাপগুলো শিশুদের ক্ষতি করছে, বিভেদ বাড়াচ্ছে এবং গণতন্ত্রক দুর্বল করে দিচ্ছে। হাউগেন ফেসবুকের গোপন তথ্য এমন সময়ে সামনে নিয়ে আসেন, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বড় এই প্রতিষ্ঠানটি দিয়ে সমালোচনা তো আছেই, এর ওপর নজরদারি বাড়ানোরও দাবি তোলা হচ্ছে। ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে ব্যর্থতা থেকে শুরু করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে। সেখানে উঠে এসে, সক্ষমতা থাকা সত্ব্বেও ২০১৬ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার সময় ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গা বিরোধী মিথ্যা সংবাদগুলো ঠেকাতে ফেসবুক কোন পদক্ষেপই নেয়নি। বিশ্লেষকদের মত মেটাভার্সের যাত্রা শুরুর আগেই এটিকে নিয়ন্ত্রণ ও আইনী কাঠামোতে আনা উচিত।