আলোকবিজ্ঞানের জনক হাসান ইবনে আল হাইথাম!

বর্তমানে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের নিকট যে মুসলিম বিজ্ঞানীর নামটি সবচেয়ে জনপ্রিয় তা হচ্ছে ‘আল হ্যাজেন’ বা আল হাইথাম।
ইবনে আল হাইথাম ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে, ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আবু আলি আল হাসান ইবনে আল হাসান ইবনে আল হাইথাম। সম্ভবত প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সবই তিনি বাগদাদে লাভ করেন। তিনি ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। ইবনে আল হাইথামের শিক্ষা জীবন শুরু হয় বসরার একটি মক্তব থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে।
তার সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী কাজ হচ্ছে ১০১১ ও ১০২১ খৃষ্টাব্দে রচিত তার “কিতাবুল মানাজির (আলোকবিদ্যার গ্রন্থ)।” তিনি একজন বহুবিদ্যাবিশারদ, যিনি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কেও লিখেছেন। ফার্সি ইতিহাসবিদ আবুল হাসান বায়হাকি তাকে “দ্বিতীয় টলেমি” বলে উল্লেখ করেছেন।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, ইবনে আল হাইথাম ছিলেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবক্তা। তার আগে বিজ্ঞানীগণ যে পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ চালাতেন তা যথাযথ ছিল না। ফলে অনেক সময় হাইথামকে বলা হয় প্রথম ‘আধুনিক বিজ্ঞানী’। তিনি যেকোনো বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কঠোর পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রচলন করেন। তার পরীক্ষার পন্থা অনেকাংশে আধুনিককালের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতো।
১০১০ খ্রিস্টাব্দে, কায়রোর খলিফা আল হাকিমের প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার সুযোগ আসে তার। আর কায়রো এসেই শুরু হয় তার প্রকৃত বৈজ্ঞানিক জীবনের, যা তাকে অমর করেছে। কায়রোতে অবস্থানকালীনই হাইথাম তার শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্র ‘বুক অব অপটিকস’ রচনা করেন।
পদার্থবিজ্ঞানের উপর প্রভাব এর ক্ষেত্রে ইবনে আল হাইথামের ‘কিতাব আল মানাজির’ তথা বুক অব অপটিকসকে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকার সমকক্ষ ধরা হয়। তার এই সাত খণ্ডে প্রকাশিত বইটি আলোকবিজ্ঞান সম্বন্ধে সমসাময়িক তো বটেই, অনাগত কয়েক প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের ধারণায় আমূল পরিবর্তন আনে। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল চোখ থেকে আলো কোনো বস্তুর উপর পড়লে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। এই ধারণাটি ছিল অ্যারিস্টটলের। কিন্তু হাইথাম বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এটি ভুল প্রমাণিত করেন। যেমন- বহুদূরের তারকারাজি আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই। আমাদের চোখের আলো কতটা শক্তিশালী যে এতো পথ মূহুর্তেই পাড়ি দিয়ে সে তারকার কাছে পৌঁছে যায়? প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি ঘোষণা করলেন কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এলেই তবে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। তিনি আলোকরশ্মির সরল পথে গমনের বিষয়েও পরীক্ষা করেন এবং প্রমাণ করেন। স্নেলের সাইন সূত্রটি বস্তুত তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। তবে তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কিংবা গাণিতিক ব্যাখ্যা করতে পারেননি হাইথাম। তাকে পিনহোল ক্যামেরা এবং ক্যামেরা অবস্কিউরার জনকও বলা হয়।
ইবনে আল হাইথাম নভোজোতির্বিজ্ঞান নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেছেন। তিনি বিভিন্ন ভরের মধ্যকার অদৃশ্য আকর্ষণের কারণে ত্বরণের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। তার ‘মাকালা ফি’ল কারাস্তুন’ নামক গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন বস্তুর আকর্ষণ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আল শুকুক আল আ বাতলামিয়াস’ তার জোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক কাজগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে তিনি মূলত টলেমির বিভিন্ন কাজের সমালোচনার মধ্য দিয়ে নিজের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে তার ‘কনফিগারেশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ এ তিনি টলেমির ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। ১০৩৮ সালে, ইবনে আল হাইথাম প্রকাশ করেন ‘মোশনস অব ইচ অব দ্য সেভেন প্লানেটস’। এই বইতে তিনি মূলত মহাকাশে গ্রহ নক্ষত্র ও তারকাদের গতি আলোচনা করেন।
গণিতে ইবনে আল হাইথাম কাজ করেছেন কণিক, সংখ্যাতত্ত্ব আর বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি নিয়ে। তিনি ইউক্লিডীয় জ্যামিতির কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধন করেছেন। তিনি বুক অব অপটিকসের পঞ্চম খণ্ডে একটি সম্পাদ্য তৈরি করেন যা ইউরোপে রেনেসাঁর সময় ‘আল হ্যাজেনস প্রবলেম’ নামে বেশ জনপ্রিয় ছিল।
ইবনে আল হাইসামএর মূল সাফল্য হলো তিনি তার তত্ত্বে ইউক্লিডের আলোকরশ্নির গাণিতিক প্রকাশকে গ্যালেনের অঙ্গসংস্থানিক বিবরণ এবং অ্যারিস্টটলের অন্তপ্রেরণ তত্ত্বের সাথে সফলভাবে একীভূত করতে পেরেছিলেন। তিনি আল-কিন্দিকে এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করে বলেন “যে রঙিন বস্তুর প্রতিটি বিন্দু হতে যতো সরলরেখা আঁকা যায় ততোদিকে আলো এবং রং এর তথ্য পরিবাহিত করে। তিনি লেন্স, আয়না, প্রতিফলন ও প্রতিসরণ সংক্রান্ত বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পাদন করেছিলেন এবং পরীক্ষার মাধ্যমে সফলভাবে দেখিয়েছিলেন যে, আলো সরল রেখায় চলে। তার প্রতিফলন ও প্রতিসরণের বিশ্লেষণ আলোর উল্লম্ব ও আনুভূমিক উপাংশকে আলাদাভাবে বিবেচনা করেছেন।
তার আরো একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্র হচ্ছে, “রিসালা ফি’ল দাও” ( আলোর উপর নিবন্ধ)। যাতে তিনি ঔজ্জ্বল্য, রংধনু, গ্রহণ, গোধুলি, জ্যোৎস্না নিয়ে আলোচনা করেছেন।
এছাড়াও তার অমর কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যানালাইসিস অ্যান্ড সিনথেসিস, ব্যালেন্স অব উইজডম, কনফিগারেশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড, অপসকুলা, মোশন অব ইচ সেভেন প্লানেটস, ট্রিটিজ অন লাইট, ট্রিটিজ অন প্ল্যাস, দ্য রেজুলেশন ইত্যাদি।
মিসরের রাজধানী কায়রােতে ১০৪৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ বিজ্ঞানী ইবনে হায়সাম ইন্তেকাল করেন। তার ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, বিয়ে, সন্তান সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। তবে তিনি ইতিহাসে জীবন্ত হয়ে আছেন তার কাজের দ্বারা।
তার সম্মানার্থে চাঁদের ইম্প্যাক্ট ক্রেটার আল-হাজেন এর নামকরণ করা হয়েছে; গ্রহাণু ৫৯২৩৯ আল-হাজেন এর নামও তাঁর নামেই। তাঁর অবদান স্মরণার্থে আগা খান বিশ্ববিদ্যালয় (পাকিস্তান) তাদের অপথালমালোজির প্রধান আসনের নামকরণ করেছে । ১৯৮২ থেকে ১০ ইরাকি দশ দিনার নোট এবং ২০০৩ সাল হতে ইরাকি ১০,০০০ দিনারের নোটে তাঁর ছবি প্রিন্ট করা হয়েছে।