জিদান মিয়াঃ রায়ো ভায়োকানোতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম ফুটবলার

ক্রিকেট নিয়ে আমরা যখন দারুণ উজ্জীবিত, ফুটবলে সেখানে অনেকখানি হতাশা। তার মানে কি বাংলাদেশিদের রক্তে ফুটবল নেই? অবশ্যই আছে। তার এক জলজ্যান্ত প্রমাণ জিদান মিয়া।
সম্প্রতি স্প্যানিশ লা লিগার দল ‘ রায়ো ভায়োকানো’ তে নাম লিখিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার জিদান মিয়া। ইংল্যান্ডে জন্ম নেয়া ২০ বছর বয়সী জিদান মিয়াকে ২০২১-২২ মৌসুমের জন্য দলে ভিড়িয়েছে স্পেনের ক্লাবটি। একইসাথে লা লিগা ক্লাবে বাংলাদেশি প্রথম ফুটবলার হিসেবে যোগ দিয়েছে জিদান।
২০০১ সালের ৭ মার্চ, যুক্তরাজ্যের কেন্ট শহরে জন্মগ্রহণ করে জিদান মিয়া। তার বাবার নাম সুফিয়ান মিয়া ও মা শিপা মিয়া। সুফিয়ান এবং শিপা, মৌলভীবাজার উপজেলার রাজনগরের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে ১৯৭০-এর দশকে লন্ডনে পাড়ি জমান। জিদান বাদে আরও দুই মেয়ে আছে এই দম্পতির।
জিদানের এই সফলতার পিছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছেন তার বাবা। সুফিয়ান মিয়া বেশ ফুটবল পাগল মানুষ। তরুণ বয়সে তিনি নিজেই নামি ফুটবলার হওয়ার জন্য নানা চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০০৯ সালে, মিডলসেক্স দলের হয়ে তিনি কাউন্টি লিগেও খেলেছিলেন। ‘জিনেদিন জিদান’ ছিলেন তার পছন্দের ফুটবলার। তার নামানুসারেই ছেলের নাম রাখেন তিনি। সুফিয়ান মিয়া বলেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকেই জিদানকে সঙ্গে নিয়ে ফুটবল প্রশিক্ষণে যেতাম। ওর বয়স যখন প্রায় সাত বছর, মাঠে বল নিয়ে তার দুরন্তপনা সবার দৃষ্টি কাড়ে’। খুব কম বয়সেই ছেলের ফুটবল প্রতিভা আর খেলার প্রতি টান আঁচ করতে পেরে তিনি জিদানকে কিংবদন্তি ডেভিড বেকহাম সকার একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন। মাত্র ৭ বছর বয়সেই স্বপ্নের তাড়া শুরু। শুরু হয় জিদানের ফুটবলার হয়ে ওঠার অভিযান।
বাবা যখন সন্তানের মাঝে নিজের অপূর্ণ স্বপ্নের জাগরণ দেখতে পান, তখন সন্তানের প্রতিভার ধার যে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। জিদানেরও ঠিক হয়েছে তা-ই। ২০০৮ সালে, জিদান বিশ্বখ্যাত “ডেভিড বেকহ্যাম একাডেমি” তে বেকহ্যামের ভাগ্নে ফ্রেডি এবং অন্যান্য অনেক বাচ্চাদের সাথে ট্রেনিং শুরু করে। শুরু থেকেই সে একাডেমি পর্যায়ের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ পায়। সেখানে দুই বছর খেলার পর, জিদান যুক্তরাজ্য এবং ওয়েলসের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন “ডুলউইচ হ্যামলেট এফসি”, “সকার এলিট এফএ”, “প্রো টাচ সকার একাডেমি” এবং শীর্ষ ফ্লাইট ক্লাব ও “ক্রিস্টাল প্যালেস” গুলোতে খেলার জন্য।
ডেভিড বেকহ্যামের একাডিমেতে দুই বছর অনুশীলন করা জিদান মাত্র ১১ বছর বয়সেই স্কলারশিপ পেয়েছিলেন আর্সেনালের একাডেমিতেও। তবে আর্সেনালের একাডেমিতে যোগ দিতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে চলে যাওয়ার কারণে।
একাডেমি পর্যায়ের টুর্নামেন্টে খেলার পাশাপাশি বাবার আগ্রহে ডেনমার্ক, স্পেন, হংকং, থাইল্যান্ডের বেশ কয়েকটি যুব দলের হয়ে খেলার মাধ্যমে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করেন জিদান।
২০১২ সালে, মাত্র ১১ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য জিদান বাবা-মা ও ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ওই বছরের ই ডিসেম্বরে তার বাবা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জেনিভার স্পাইয়ার ইনস্টিটিউট’ এ নিয়ে যান প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে জিদান বিশ্বখ্যাত অ্যাথলেটিকস প্রশিক্ষণকেন্দ্র মাইকেল জনসন পারফরম্যান্স সেন্টারের (এমজেপিসি) কর্তাদের নজর কাড়ে। তারা জিদানকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বৃত্তি প্রদান করেন।
চিত্রঃ মাইকেল জনসন ও ব্রায়ান ম্যাককালের সঙ্গে জিদান
ফুটবলে আরও ভালো সুযোগের কথা বিবেচনা করেই ২০১৪ সালের আগস্টে, সে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের মাইকেল জনসন পারফরম্যান্স সেন্টারে (এমজেপিসি) বদলি হয়। ইতিমধ্যে সে ডালাস টেক্সাস ক্লাসিক লিগ, দ্য ডালাস মেমোরিয়াল টুর্নামেন্ট ও টেক্সাস ব্লু কাপ টুর্নামেন্টে নিয়মিত খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে।
প্রায় দেড় বছর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে “এরি এফসি”, “কলম্বাস ক্রু অনূর্ধ্ব-১৪” দলের জন্য এবং টেক্সাসের “মাইকেল জনসন পারফরমেন্স সেন্টার”-এর পক্ষ থেকে বৃত্তি অর্জনের পর, প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ছয় বছর ধরে জিদান খেলছে এফসি ডালাস অনূর্ধ্ব ১৫ দলে। দুই মাসের ট্রায়াল দিয়ে ভ্যালেকাস শ্রেণিবিন্যাসকে প্রভাবিত করে রায়ো ভালেকানোতে সাইন করার আগে জিদান “ব্রোমলি এফসি অনূর্ধ্ব-২৩” দলের হয়ে খেলতে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।
সর্বশেষ এই বছরের আগস্টে, লা লিগার দল রায়ো ভায়োকানোতে যোগ দিয়েছে জিদান মিয়া। মাদ্রিদভিত্তিক স্পোর্টস ম্যানেজম্যান্ট এজেন্সি ”অ্যান্থেম স্পোর্টস তার চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি টুইট করে। সেই পোস্টে তারা জানায়, ‘প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জিদান মিয়াকে লা লিগায় চুক্তিবদ্ধ করতে পেরে আমরা আনন্দিত।’ স্পেনের দলটির ‘সি’ টিমে যোগ দিয়েছে জিদান। তবে অনুশীলন করবে ‘বি’ দলের হয়ে।
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই জিদান দেখিয়েছিলো তার ফুটবল প্রতিভার ঝলক। ২০১৬ সালে, এশিয়ান ফুটবল অ্যাওয়ার্ডস আসরে ফুটবলের উদীয়মান তারকা হিসেবে জিদান পান ‘স্পেশাল রিকগনিশন অ্যাওয়ার্ডস’।
চিত্রঃ এশিয়ান ফুটবল অ্যাওয়ার্ডস আসরে জিদান মিয়া
বাংলাদেশ ফুটবল জাতীয় দলের হয়ে খেলার আগ্রহ ও প্রকাশ করেছেন জিদান মিয়া। গত বছর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যস্ততার কারণে বাংলাদেশের ফুটবল সম্পর্কে তেমন খোঁজ রাখতে পারিনি। বাংলাদেশের হয়ে খেলার ইচ্ছা রয়েছে। আমার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা হয়নি। তবে করা হলে ইচ্ছা আছে দেশের হয়ে মাঠে নামার।’ সেইসাথে তার বাবা-মায়েরও চাওয়া, ছেলের গায়ে উঠুক বাংলাদেশের জার্সি।
পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নের পিছনে ছুটলেও পড়াশোনার ক্ষেত্রে কোনো কমতি রাখেনি জিদান। পড়াশোনার পাশাপাশি ই ক্যারিয়ার গড়ছে সে। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে বেশির ভাগই খেলতে হয় ফুটবল ম্যাচ।
জিদান জানায়, ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন তাড়া করতে গিয়ে ক্রীড়াঙ্গনের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছে তার। যারা তার ব্যক্তিজীবনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।
যুক্তরাজ্যের রাজনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি ও বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা ইতিমধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। আর এবার নাম লেখালেন ফুটবলেও।
ভালো ফুটবলার হয়ে উঠার অনুষঙ্গগুলো ছোটবেলা থেকেই জিদানের মধ্যে দৃশ্যমান ছিল। বল পায়ে তেজি ভঙ্গি আর দারুণ গতি জিদানকে এগিয়ে দিয়েছে বারবার। দৈহিক ক্ষিপ্রতা, শৃঙ্খলা আর ফুটবলার হয়ে উঠার প্রবল ইচ্ছাশক্তির কারণেই আজ এই জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে জিদান। তাই মাত্র ২০ বছর বয়সেই সমগ্র বাংলাদেশের গর্বের জায়গা দখল করে নিয়েছে সে। একদিন বাংলাদেশের জাতীয় দলের হয়ে খেলবে জিদান, এটাই এখন প্রত্যাশা।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়