
মাহিদেভরান ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রথম সুলাইমানের পত্নী, প্রধান সঙ্গী এবং শাহজাদা মুস্তাফার মা।
তিনি আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মাহিদেভরানের সমসাময়িক নথিপত্রসমূহে তার পিতার নাম হিসেবে আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান বা আবদুল মেননান উল্লিখিত রয়েছে যা ইঙ্গিত করে যে, তিনি একজন অজানা বংশোদ্ভূত ইসলাম ধর্মান্তরিত ক্রীতদাসী ছিলেন। মাহিদেভরানের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তার জাতিগত পরিচয় বিতর্কিত। নিকোলাই ইওর্গা এর মতে, তিনি মন্টিনিগ্রো হতে আগত। আবার অনেকের মতে, তিনি একজন আলবেনীয়ান অথবা সার্ক্যাসীয় ছিলেন।
সুলতান সুলেমান তাকে আদর করে ডাকতেন “গুলবাহার”, যারা অর্থ “বসন্তের গোলাপ”। মাত্র ১৪ বছর বয়সে শাহজাদা সুলেমানের হেরেম এ ধরে আনা হয় তাকে। সুলেমান মানিসার গভর্নর থাকাকালীন তাঁর হারেমের সতেরোজন নারীর মধ্যে মাহিদেভরান তালিকাভুক্ত ছিলেন; তখন তিনি কোনো উচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী সঙ্গিনী ছিলেন না, কারণ তিনি সুলেমানের আরও দুজন উপপত্নীর সাথে দৈনিক উপার্জন হিসেবে ৪ আসপার করে পেতেন, যেখানে অন্য তিনজন উপপত্নী ৫ আসপার করে পেতো।
কিন্তু অসাধারণ রূপ লাবণ্যের অধিকারী হওয়ায় ১৫ বছর বয়সেই সুলতানের মন জয় করে নেন তিনি। ১৫১৫ সালে, মনিসায় থাকাকালীন মাহিদেভরান সুলতান তার একমাত্র সন্তান শাহজাদা মুস্তাফার জন্ম দেন এবং ধীরে ধীরে সুলেমানের প্রিয়তম ও প্রধান সঙ্গিনী হয়ে উঠেন।
১৫২০ সালে, যখন সুলতান প্রথম সেলিম মৃত্যুবরণ করেন তখন সুলেমান সিংহাসনে আরোহণের জন্য তার পরিবারসহ উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুল চলে যান। পরবর্তীতে ১৫২১ সালে, যখন সুলেমানের আরেক উপপত্নী গুলফাম এর ঘরে জন্ম নেওয়া শাহাজাদা মাহমুদ এবং অপেক্ষাকৃত বড় শাহজাদা মুরাদ মৃত্যুবরণ করে, তখন শাহজাদা মুস্তাফা তাঁর রাজকীয় প্রজন্মের জ্যেষ্ঠ শাহজাদা হয়ে উঠেন এবং ভবিষ্যতে উসমানীয় সিংহাসনে আরোহণের ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে চলে যান। এই সুবাদে মাহিদেভরান সুলতান উচ্চতর পদে আসীন হন।
ততদিন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ই চলছিলো। সুলতান এবং ছেলে কে নিয়ে খুবই আনন্দপূর্ণ জীবন-যাপন করছিলন মাহিদেভরান। কিন্তু ১৫২১ সালে, যখন হুররাম সুলেমান এর হেরেম এ দাসী হয়ে আসে, মাহিদেভরান এর জীবন নাটকীয় ভাবে পালটে যায়। নজরকাড়া সৌন্দর্য, মনভোলানো হাসি আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অল্পকিছু দিনের মধ্যেই সুলতানের মন জয় করে নেয় হুররাম।
এছাড়াও হুররাম ১৫২২ সালে তার প্রথম পুত্র মেহমেদ এবং ১৫২৪ সালে সেলিমের(ভবিষ্যৎ সুলতান দ্বিতীয় সেলিম) জন্ম দেন, যা সুলতান সুলেমানের একমাত্র পুত্রসন্তানের মা হিসেবে মাহিদেভরান সুলতানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে। তিনি হুররামের পূর্বে সুলেমানের প্রিয়তম সঙ্গিনী ছিলেন। যখন হুররাম সুলেমানের নতুন প্রিয় সঙ্গিনী এবং পরে বৈধ স্ত্রী হয়ে উঠেন, তখনও মাহিদেভরান সুলতান সুলেমানের প্রথম স্ত্রী এবং জ্যেষ্ঠ ছেলের মায়ের মর্যাদা ধরে রেখেছিলেন। যদিও তিনি কখনো সুলেমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি, কিন্তু তিনি স্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। কারণ, অটোম্যান প্রথা অনুযায়ী তিনি সুলেমানের ‘বাস কাদিন’ ছিলেন যার অর্থ ‘প্রধান স্ত্রী’, যা ‘হাসেকি সুলতান’ উপাধি সৃষ্টির আগে এবং পরে একজন সুলতানের প্রিয়তম সঙ্গিনীর জন্য সর্বোচ্চ পদ ছিল।
এছাড়াও যখন হুররাম সুলতান সুলেমানের বিবাহিতা ও বৈধ স্ত্রী হয়ে উঠে এবং সুলতানা উপাধি লাভ করে তখন সুলতানের অন্য সব সঙ্গিনীরা ‘হাতুন’ নামক অন্য একটি উপাধি বহন করতে শুরু করে যার অর্থ ছিল ভদ্রমহিলা। কিন্তু মাহিদেভরানের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যভাবে ঘটে, কারণ তিনি সুলেমানের অন্য সাধারণ সঙ্গিনীদের মতো ছিলেন না। তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের তৎকালীন যুবরাজ এবং সবচেয়ে যোগ্য উত্তরাধিকারী শাহজাদা মুস্তাফার মা ছিলেন।
বার্নার্ডো নাভাগেরো থেকে লিপিবদ্ধ হয় যে, সুলেমান তোপকাপি হারেমে হুররামের পাশাপাশি মহিদেভরানকে অত্যন্ত স্নেহ ও সম্মান করতেন। কিন্তু ১৫২৬ সালের দিকে, তিনি মাহিদেভরানের প্রতি মনোযোগ সরিয়ে তার সমস্ত আবেগ হুররামের প্রতি নিবদ্ধ করেন।
তুর্কী ঐতিহ্য অনুসারে, সকল শাহজাদাদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে প্রাদেশিক গভর্নর (সানজাক-বে) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আনুমানিক ১৫৩৩ বা ১৫৩৪ সালের দিকে, শাহজাদা মুস্তাফা মানিসা প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার কারণে মাহিদেভরান তার পুত্র মুস্তাফাসহ ইস্তাম্বুল ছেড়ে মানিসা চলে যান। উসমানীয় ঐতিহ্য অনুসারে, মাহিদেভরান সুলতান তার ছেলে মুস্তাফার রাজকীয় হারেমের প্রধান কর্ত্রী ছিলেন।
বয়সের সাথে সাথে শাহজাদা মুস্তফার শত্রুর সংখ্যা ও বাড়ছিলো উত্তরোত্তর। মানিসার আগাদের মতে, শাহজাদার খুশি ই ছিলো মাহিদেভরান এর একমাত্র খুশি। তিনি তার ছেলের জীবনের শেষ দিন অবধি তাকে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন এবং সম্ভবত এ কাজ করার জন্য একাধিক সংবাদবাহকের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন।
১৫৫৩ সালে, সাফাভিদ পারস্যের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় সুলেমান মুস্তাফার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন, যে কিনা তাঁর পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনার করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলো; যদিও যে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তা কখনও প্রমাণিত হয়নি।
শাহজাদা মুস্তাফার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরে বেশ কয়েক বছর ধরে, মাহিদেভরান সুলতান বেশ কষ্টকর জীবন যাপন করেছিলেন। তিনি ‘ভালি আহাদ’ বা যুবরাজের মাতার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে বুরসায় ফিরে যান তিনি, যেখানে তার ছেলে শাহজাদা মুস্তাফাকে সমাধিস্থ করা হয়। তিনিই বুরসায় নির্বাসিত সুলেমানের শেষ উপপত্নী ছিলেন। ছেলের মৃত্যুর সাথে সাথে দূর্বিষহ হয়ে উঠে তার জীবন। সম্ভবত ছেলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কারণে তিনি তার বাড়ি ভাড়া দিতে পারছিলেন না এবং তার সেবাকারী চাকরেরা প্রায়শই স্থানীয় বাজারে তিরস্কার ও প্রতারণা শিকার হতো।
মাহিদেভরানের অবস্থার উন্নতি হয় সুলেমানের রাজত্বের শেষের দিকে। যখন সুলাইমানের একমাত্র জীবিত পুত্র, মুস্তফার সৎ ভাই সুলতান ২য় সেলিম তার সব ঋণ পরিশোধ করে দেন এবং তার জন্য একটি বাড়ি ক্রয় করেন। শেষ পর্যন্ত আর্থিকভাবে নিশ্চিন্ত হয়ে, মাহিদেভরানের নিকট তার ছেলের মাজার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ প্রদানের পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ আয় ছিল।
তার পুনর্বাসন কেবল ১৫৫৮ সালে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হুররামের মৃত্যুর পরই সম্ভব হয়েছিল। ১৫৮১ সালে, সুলেমান ও তার সমস্ত সন্তানকে আয়ুর দিক দিয়ে ছাড়িয়ে মাহিদেভরান সুলতান মৃত্যুবরণ করেন এবং মুস্তাফার সমাধিতে তাকে দাফন করা হয়।