
ইব্রাহিম পাশা ছিলেন তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের মহান সম্রাট “সুলতান সুলাইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট ” দ্বারা নিযুক্ত অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম উজিরে আজম।
ইব্রাহিম পাশা ১৪৯৫ সালে, ভেনিস প্রজাতন্ত্রের তৎকালীন এপিরাসের পারগা শহরে এক অর্থোডক্স খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে অর্থোডক্স খ্রিস্টান হলেও, পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। তার পুরো নাম পারগালি ইব্রাহিম পাশা। তিনি পশ্চিমে “ফ্রেঙ্ক ইব্রাহিম পাশা” এবং “মকবুল ইব্রাহিম পাশা” নামেও পরিচিত। জন্মগত ভাবে স্লাভিক উপভাষী হলেও গ্রিক ও আলবেনিয় ভাষায় ও পারদর্শী ছিলেন তিনি। তার বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে ধারনা করা হয়, তার বাবা পেশায় একজন নাবিক ছিলেন।
১৪৯৯ থেকে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে, অটোমান সাম্রাজ্যের বসনিয়ার গভর্নর ইস্কান্দার পাশা’র অতর্কিত আক্রমণে বন্দি হন এবং দাস হিসেবে নিযুক্ত হন ইব্রাহিম পাশা। সম্ভবত ১৫১৪ সালে, এডির্ন-এর নিকটবর্তী ইস্কান্দার পাশা’র এস্টেটে অবস্থানকালে শাহজাদা সুলাইমানের সাথে প্রথম সাক্ষাত হয় তার। এরপরেই তাকে সুলাইমানের সেবায় নিযুক্ত করা হয়।
সুলতান সুলেমান ১৫২০ সালে, সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন থেকেই ইব্রাহিম পাশা বিভিন্ন রাজদায়িত্ব প্রাপ্ত হতে থাকেন। তার প্রথম দায়িত্ব ছিল সুলতানের বাজপাখি পালন। পরবর্তীতে ইব্রাহিমকে সুলেমানের সাম্রাজ্যের ‘সিরাসাকার’ (উচ্চপদস্থ রাজ কর্মকর্তা, যার অধীনে একইসঙ্গে কূটনীতি এবং সেনাবাহিনী পরিচালনার ক্ষমতা থাকে) নিযুক্ত করা হয়।
আনুমানিক ১৫২৩ সালে, তিনি সুলতান সুলেমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। সুলেমান তাকে পূর্ববর্তী সম্রাট এবং তার পিতা সুলতান সেলিম-১ কর্তৃক নিয়োজিত প্রধান উজির পিরি মেহমেদ পাশা’র স্থলাভিষিক্ত করেন। পরবর্তী ১৩ বছর, ইব্রাহিম নিযুক্ত পদে বহাল থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। সুলতান সুলেমানের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন এই প্রধান উজির অটোমান সাম্রাজ্যে সমসাময়িক অন্যান্য গ্র্যান্ড উজিরদের চেয়ে ক্ষমতাশালী এবং জনপ্রিয় ছিলেন।
১৫২৪ সালে, যখন সাম্রাজ্যভুক্ত মিশরের গভর্নর হাই আহমেদ পাশা নিজেকে স্বাধীন শাসক ঘোষণা করেন, তখন ইব্রাহিম পাশা তাকে পরাজিত এবং নিহত করেন। শুধু তাই নয়, এক বছরের মধ্যে তিনি মিশরীয় সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করেন। সেই সঙ্গে সেখানকার আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশ জারি করেন। ১৫৩৩ সালে, সুলতান সুলেমানের বোন মুহসিন হাতুনকে বিয়ে করেন ইব্রাহিম পাশা। এই বিয়ের ফলে পরবর্তীতে তুরস্কের একজন বনেদী পরিবারের সদস্য হয়ে যান তিনি। হাতুন স্বামীকে নিয়ে প্রথম দিকে যথেষ্ট সন্দিহান থাকলেও পরবর্তীতে তারা সুখী দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করেন। যদিও জনশ্রুতি আছে যে, ইব্রাহিম পাশা সুলতান সুলেমানের বোন হেটিজা সুলতানকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস ঘেটে এমন কোনো বিয়ের তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কূটনৈতিক দিক দিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে ইব্রাহিমের সাফল্য অসাধারণ। ক্যাথলিক শাসকদের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তিতে তিনি সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এমনকি ভেনাসের কূটনৈতিকরাও তাকে ‘ইব্রাহিম দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট’ নামে ডাকতেন, যা ছিল সুলতান সুলেমানের উপাধি! ১৫৩৩ সালে তিনি রাজা চার্লস-৫ কে রাজি করান হাঙ্গেরিকে অটোমান সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত রাজ্য হিসেবে মেনে নিতে। ফ্রান্সের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গেও তিনি বিভিন্ন সমঝোতাপূর্ণ চুক্তি করতে সফল হন।
যদিও ইব্রাহিম পাশা অনেক আগে থেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তার শিকড়ের সাথে কিছুটা সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, এমনকি তার বাবা-মাকেও উসমানীয় রাজধানীতে তার সাথে থাকতে দিয়েছিলেন, যেখানে তারাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা ইউসুফ নামটি গ্রহণ করেছিলেন এবং এপিরাসের গভর্নর হয়ে ওসমানীয় অভিজাতদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন।
ক্রমান্বয়ে পাশা কূটনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষমতা এবং সামরিক অভিযানে দক্ষতার পরিচয় দিতে থাকেন এবং খুব দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে যান। এক পর্যায়ে তিনি সুলতানকে অনুরোধ করেন, তাকে যেন এত দ্রুত পদোন্নতি না দেওয়া হয়, কারণ এতে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্র্যান্ড উজিরদের কাছে তিনি চক্ষুশূল হয়ে পড়তে পারেন। তার এই বিনয়ে মুগ্ধ হয়ে সুলতান সুলেমান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তার শাসনামলে কখনো ইব্রাহিম পাশা কে হত্যা করা হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সুলেমান তার এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেন নি।
ইতিহাস অনুসন্ধান করে যতটুকু জানা যায়, সুলেমানের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র এবং ঘনিষ্ঠ ইব্রাহিম ১৫৩২ থেকে ১৫৫৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী অটোমান-সাফালিড যুদ্ধের এক পর্যায়ে সুলতানের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। এর কারণ ছিল, তার নিজ কর্তৃক ‘সিরাসকার সুলতান’ উপাধি গ্রহণ। যা ছিল সুলেমানের জন্য রীতিমতো অপমানজনক। এছাড়া এই যুদ্ধ চলাকালীন অন্য একজন সেনাধিপতি ইস্কান্দার সেলেবি’র সঙ্গেও ইব্রাহিম পাশা নেতৃত্ব সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমান্বয়ে এসব দ্বন্দ্বের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে ১৫৩৬ সালে, সুলেমান ইব্রাহিম পাশা কে হত্যা করার নির্দেশ দেন এবং রাষ্ট্র তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।
১৫৩৬ সালের ১৫ মার্চ, সুলাইমানের নির্দেশে ‘টোপকাপ প্রাসাদে’ এক নৈশভোজ অনুষ্ঠানে নিঃশব্দ জল্লাদদের দ্বারা বিনা ব্যাখ্যা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় ইইব্রাহিম পাশা কে। মৃত্যু কালে তার বয়স হয়েছিলো ৪৩ বছর।
তবে অনেকে মনে করেন, ইব্রাহিম পাশা ছিলেন সুলেমানের স্ত্রী হুররাম সুলতানের ষড়যন্ত্রের শিকার। কারণ, তিনি সুলেমানের পরে শাহজাদা মুস্তাফাকে সিংহাসনের দাবীদার হিসেবে সমর্থন দিয়েছিলেন। যদিও সুলতান সুলেমান পরবর্তীতে ইব্রাহিম পাশা কে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার জন্য স্ব-রচিত কবিতার মাধ্যমে আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
আজও পাশা’র বাড়ি ইস্তাম্বুলের হিপোড্রোমের পশ্চিমে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যা বর্তমানে ‘টার্কিশ অ্যান্ড ইসলামিক আর্টস মিউজিয়াম’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়