তালেবানের পুনরুত্থান, সম্ভাব্য মার্কিন-চীন দাঁতাত ও আফগানিস্তানের ভবিষ্যত

বলা হয়,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত মিত্র থাকলে,শত্রুর আর প্রয়োজন পড়ে না। কথাটি হয়ত এখন ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন,ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত কয়েক বছর ধরে,আফগানিস্তানে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ফেলেছে তার সরকার। আফগান সরকারকে বেশ কিছু সড়ক,বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাঁধ তৈরি করে দিয়েছে ভারত।যা করতে যেয়ে ঝরে গেছে ২২ জন ভারতীয় নাগরিকের প্রাণ। তবে এত প্রাণের বিনিময়ে,ভারতের উদ্দেশ্য ছিল সদুরপ্রসারী। আফগানিস্তানে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করা। শত্রুদেশ পাকিস্তানকে চাপে রেখে,তার বিরুদ্ধে নতুন ফ্রন্ট খোলা। দিল্লীর এই উচ্চভিলাষী প্রকল্পের পেছনে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য ইন্ধন ছিল।ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকে আঞ্চলিক পরাশক্তির স্বীকৃতি থেকে শুরু করে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদানের ক্ষমতার টোপ দিয়েছিলেন বলে অনেক সংবাদ মাধ্যম এখন দাবি করছে।
কিন্তু সবকিছুতে জল ঢেলে দিয়েছে আফগান তালেবানের পুনরুত্থান। এই মুহুর্তে আফগানিস্তানের ৬৫% এলাকা তালেবানের দখলে আছে। দ্রুতগতিতে তারা রাজধানী কাবুলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দিশাহীন ভারত এই অগ্রযাত্রা দেখে একের পর এক কূটনীতিক ভুল করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আফগান বাহিনীকে অস্ত্র দেয়া, সংসদে তালেবানদের স্বীকৃতি না দেয়ার হুশিয়ারি দিচ্ছেন ভারত সরকারের কর্তারা। আবার গোপনে তাদের সাথে বৈঠকের কথাও মিডিয়ায় এসেছে।তাই, সবমিলিয়ে তালেবানদের নিয়ে মোদি সরকারের অস্বস্তি ও সিদ্ধান্তহীনতা চোখে পড়ার মত।খোদ বিজেপি সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যাক্তিরাই এখন পত্র-পত্রিকায় মোদির আফগান নীতির সমালোচনা করছেন। সাবেক কুটনীতিক বিবেক কাতজু তো সরাসরি বলেই দিয়েছেন, আফগানিস্থানে হারতে যাচ্ছে ভারত। তবে তারা সবাই গোড়ায় গলদটা এড়িয়ে যাচ্ছেন। আর তা ছিল,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করা। ৯/১১ হামলার পর,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেররের সঙ্গী ভারতীয়রা হয়ত ভাবতে পারেনি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের একা ফেলে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হল, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখন ওয়ার অন টেরর মডেল থেকে অনেকটা সরে এসেছে।

মূলত চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থান নিয়ে মার্কিন সরকার বেশ শঙ্কিত। এই মুহুর্তে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে,জাপান সাগর কিংবা মালাক্কা প্রণালীতে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি নৌবহর। মার্কিনিরা ভালো করে জানে, যে কোন আগ্রাসনের জন্য এই সংখ্যা যথেষ্ট নয়। তাদের চাই আরো লোকবল,আরো সেনা । তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে এসে, চীনের দিকে মনযোগী হতে শুরু করে। ২০১৮ সালেই অনেক মার্কিন সামরিক কর্তারা জানতেন, তাদের আফগানিস্তান ছাড়তে হবে। কিন্ত ব্যাতিক্রম ছিল ভারত। এসব ভাবনা যেন তাদের স্পর্শই করেনি। ভারতের বেশ কয়েকজন সিনিয়র কূটনীতিক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, ২০১৮ সালে যখন মার্কিনিরা যখন গোপনে তালেবানদের সাথে আলোচনা শুরু করেছিল, তখনও ভারত তালেবানদের সাথে কোন আলোচনা দূরে থাক, তাদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছিল। ২০১৮ সালেই রুশ সামরিক মুখপাত্র, মারিয়া যাখারোভা দাবি করেন,আফগানিস্তানে ‘চিহ্নবিহীন’ হেলিকপ্টারে করে, ইসলামিক স্টেট জংগিদের নামিয়ে দেয়া হচ্ছে।তাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন,অই অঞ্চলের আকাশ পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে ন্যাটো বা তার মিত্ররা। তাদের অজ্ঞাতে, এ ধরনের ফ্লাইট চলাচল করা অসম্ভব। একই সময়ে পাকিস্তানি মিডিয়া দাবি করে,আফগানিস্তানে নিযুক্ত সেসময়কার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আমর সিনহা সরাসরি আফগান দায়েশকে অস্ত্র সরবরাহ করছেন।যার জন্য আফগান তালেবানদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে ভারতীয়রা।

ভারতের এত সব প্রচেষ্টার কারণ,তাদের শত্রু দেশ পাকিস্তান। এই মুহুর্তে আফগান তালেবান ইস্যুতে সাচ্ছন্দেই আছে পাকিস্তানিরা। কুটনৈতিক মহলে তাদের গুরত্ব আগের চেয়ে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে রাশিয়াকে ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠা হবার মূল্য ভালোভাবেই দিতে হচ্ছে ভারতকে। তালেবান ইস্যূতে ভারতের চেয়ে পাকিস্তানকেই গুরত্ব দিয়ে দেখছে মস্কো। পাকিস্তানের অপর মিত্র চীন, এরই মাঝে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তালেবানদের সাথে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করেছে। তালেবানদের দিক থেকেও এটা কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। পাকিস্তান কিংবা আমিরাতের বাইরে তারা এই প্রথম একটি পরাশক্তির সাথে বৈঠক করছে। যা তালেবানদের অতীত থেকে শিক্ষা নেবার বিষয়টাকে সামনে আনছে। আর এতে করে তাদের মুলোমুলি করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি একইভাবে তারা একসময়কার শত্রু তেহরানকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে এসেছে।

চীনের সাথে বৈঠকে তালেবান প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের মাটি চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। মূলত আফগানিস্তানের পাশেই চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। সেখানকার ইস্ট তুর্কেমেনিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট গ্রুপের সদস্যদের কথাই বলেছেন তারা। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই তালেবানদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এবং আফগানিস্তানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
এদিকে নানামুখি চাপ থেকে নিজের ইমেজ রক্ষার্থে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্থনি ব্লিঙ্কেনকে দিল্লীতে এনেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তবে আফগান ইস্যুতে মার্কিন ও ভারতের অবস্থান যে আলাদা,তা এই সফরেই কিছুটা প্রকাশ পেয়ে গেছে। যেখানে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকর, জোর করে ক্ষমতা দখল করলে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন তার শব্দচয়নে ছিলেন সতর্ক। তিনি বলেছেন,এমন কিছু করলে আফগানিস্তান একটি বিচ্ছিন্ন দেশে পরিণত হবে। এমনকি চীনের সাথে তালেবানদের বৈঠককে তিনি ইতিবাচক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। যা ভারতীয় মিডিয়াকর্মী ও একাডেমিকদের বিস্মিত করেছে। তবে কি চীন মার্কিন দাঁতাত চলছে?

ব্লিংকেনের ভারত সফরের আগে, গত ২৫শে জুলাই, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উল্লেখ্য সেই বৈঠিকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, আফগানিস্তানের পাশেই অবস্থিত চীনের তিয়ানজিং শহরে। বৈঠক শেষে মার্কিন ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান,চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়ন শুধুমাত্র ‘প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক’। তারা কেউ সংঘর্ষ চায় না। উভয় পক্ষই শান্তিতে বিশ্বাস করে।
সবশেষ, ভারত সরকার তার অপারেটিভদের আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এরই মাঝে ভারতকে চূড়ান্ত হতাশ করে, নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে বাইডেন সরকার। বিশ্লেষকরা মনে করেন,কুটনীতিতে চূড়ান্তভাবে ব্যার্থ হলে, ভারত হয়ত,তার আগের কৌশল- তালেবান বিরোধী গ্রুপগুলোকে সাহায্য করায় ফিরে যাবে। আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তানকে নির্ভার মনে হলেও, ইমরান খান সরকারের নিজস্ব চিন্তার কারণ আছে। আর তার নাম,পাকিস্তানি তালেবান। তালেবানদের কূটনীতিক ও রাজনৈতিক দুরদর্শিতা এখানে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।অতীত শত্রুতা ভূলে তারা অনেকের সাথেই আলোচনার টেবিলে বসেছে। আবার এদিকে সমানতালে যুদ্ধও করে যাচ্ছে। হয়ত আফগানিস্তান ছেড়ে মার্কিনিরা চলে যাবার কিছু পরেই তারা কাবুল দখল করে নিবে। কিন্তু তারপর? তা হয়ত আগামী কিছুদিনের মাঝেই জানা যাবে।হয়ত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এড়িয়ে আপাতত আফগানিস্তানের দিকেই মনযোগ দিবে তালেবান। কিন্তু এটা নিশ্চিত, আফগানিস্তানের তালেবানদের পুনরুত্থান উপমহাদেশের ভুরাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিতে চলেছে।