ইব্রাহিম রাইসিঃ ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ১৩ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিশাল জয় পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ডানপন্থী বিচারক সাইয়েদ ইব্রাহিম রাইসি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দেশটির শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ির বন্ধু। গত ১৮ জুন অনুষ্ঠিত ইরানের ১৩ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোট গৃহীত ভোটের অর্ধেকের বেশি পেয়ে ৫ বছরের জন্য ইরানের মসনদে বসেছেন তিনি।
এর আগে ২০১৭ সালে রাইসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী হাসান রুহানির কাছে হেরে যান তিনি। এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই তাকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিভিন্ন জরিপে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার নাম উঠে আসে। মূলত আহমেদিনিজাদের মতো শক্তিশালী প্রার্থীরা আগেই প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়ায় রাইসিই ছিলেন সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী।
অবশ্য নির্বাচনের আগেই অনেক ইরানিই রাইসির বিজয়ের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। কারণ তাদের মতে, এই নির্বাচন পুরোটাই পাঁতানো এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সুদৃষ্টিতে থাকা রাইসিই বিজয়ী হবেন।
৬০ বছর বয়সী রাইসি বর্তমানে দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম।
কিন্তু কে এই রাইসি!
রাইসির পুরো নাম সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসুল-সাদাতি। ১৯৬০ সালে, ইরানের দ্বিতীয় বড় শহর মাশহাদ এ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ইতিহাস ও সংগ্রামের জৌলস ছড়ানো ভূমি মাশহাদেই ছোটবেলা কেটেছে ইব্রাহিম রাইসির। রাইসির বাবা ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতা। ইব্রাহিম রাইসির বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন তার বাবা মারা যান। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি ১৫ বছর বয়সে পবিত্র কুম শহরে এক শিয়া মাদ্রাসায় যোগ দেন।
সেখানে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়, পাহলভী রাজবংশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৯ সালে, ইরানি বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির কাছ থেকে দীক্ষা নেন রাইসি। নিবিড়ভাবে ধর্মীয় জ্ঞান আয়ত্ত করায় হোজ্জাত- আল- ইসলাম (ইসলামের প্রামাণ্য অবয়ব) উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাকে।
রাইসির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। শুধু এটুকুই জানা যায় যে তার স্ত্রী জামিলে তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, এবং তাদের দুটি সন্তান আছে। তার শ্বশুর আয়াতোল্লা আহমাদ আলামোলহোদা ও একজন কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা।
আয়াতুল্লাহ খামেনির জন্ম ইরানের যে অঞ্চলে রাইসিরও জন্ম সেই মাশহাদ এলাকায়। অতিরক্ষণশীল রাইসির অবশ্য শিয়া ইমামদের মতো ‘আয়াতুল্লাহ’ পদমর্যাদা নেই। তবে তার দাবি, তিনি ইসলামের প্রবক্তা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটতম বংশধর। আর এই বংশ মর্যাদার কারণে তিনি কালো পাগড়ি পরেন।
ইব্রাহিম রাইসি তার কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেছেন। বিপ্লব পরবর্তী বছর ১৯৮০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে রাইসি কারাজ শহরের প্রসিকিউটর জেনারেল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে গঠিত বিপ্লবী আদালতের ডেপুটি প্রসিকিউটর, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত তেহরানে প্রসিকিউটর জেনারেল, ২০০৪ সাল পর্যন্ত জুডিশিয়াল অথরিটির ডেপুটি চিফ ও ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় প্রসিকিউটর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
রেভ্যুলুশনারি আদালতের প্রধান বিচারক ছিলেন রাইসি। আর ওই বিচার প্রক্রিয়ার পরই খামেনেয়ির আস্থাভাজন হিসেবে উত্থান ঘটে তার। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সম্পদশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভি ফাউন্ডেশনের প্রধান হিসেবে রাইসিকে নিয়োগ দেন খামেনি।
তিন বছর মোটামুটি সফলভাবে আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভি ফাউন্ডেনের নেতৃত্ব দেওয়ার পর ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান পদে নিয়োগ দেন খামেনি। এ পদে থাকার সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা পান রাইসি। একই বছর তাকে অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টসের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়, যেটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান। আয়াতুল্লাহ খামেনির মৃত্যুর পর পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা কে হবেন তা নির্বাচনের দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানটির। সেই সুবাদে খামেনির উত্তরসূরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল রাইসির।
তবে বলা হয়ে থাকে, ১৯৮৮ সালের দিকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সমাপ্তি লগ্নে একাধিক রাজনৈতিক বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন রাইসি। ওই সময় তিনি ছিলেন তেহরানের বিপ্লবী আদালতের বিচারক। মানবাধিকার সংগঠনগুলির দাবি, বিপ্লবী আদালতের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন রাইসি। যার কারণে দেশ গঠনে রাইসির ভূমিকা নিয়ে বহু ইরানি এবং মানবাধিকারকর্মী এর আগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যদিও ২০১৮ সালে, এমনকি গত বছরও রাজবন্দিদের গণফাঁসির বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে রাইসি তার সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন।
তাছাড়া ইরানের নবনির্বাচিত এই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অনেক আগেই যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। অর্থাৎ ইরান এমন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে, যার ওপর আগে থেকেই নাখোশ মার্কিন প্রশাসন।
ইব্রাহিম রাইসি যখন ২০২১ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রার্থী হবার ঘোষণা দেন, তখন তিনি বলেন “রাজনীতির মঞ্চে তিনি একজন নিরপেক্ষ প্রার্থী। তিনি দেশটির নির্বাহী পরিচালনা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনবেন এবং দেশটিতে দারিদ্র, দুর্নীতি, অবমাননা এবং বৈষম্য দূর করাই হবে তার লক্ষ্য।” পাশাপাশি নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য ৪০ লাখ ঘর নির্মাণ ও ‘শক্তিশালী ইরানের জন্য জনগণের সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ও সে সময় দেন তিনি।
এখন প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে কতটা সফল হন তিনি, সেটাই দেখার অপেক্ষায় পুরো বিশ্ব।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়