পেগাসাসঃ এসপিওনাজের উড়ন্ত ঘোড়া

২০১৭ সালের গোড়ার দিকের কথা, কানাডার মন্ট্রিলে বাস করা সৌদি এক্টিভিস্ট ওমর আবদুল আজিজ, তার মোবাইল ফোনটি নিয়ে একজন আইটি স্পেশালিস্টের কাছে এসেছেন। বলা ভাল, সেই আইটি স্পেশালিস্টই তাকে ডেকে এনেছেন। সিটিজেন ল্যাব নামে এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপি সাইবার নিরাপত্তা,সচ্ছতা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা এক্টিভিস্টদের গোয়েন্দা সংস্থার সাইবার নজরদারির হাত থেকে রক্ষা করে। সেই বিশেষজ্ঞরাই আবিষ্কার করেন,কানাডার মন্ট্রিলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরি থেকে প্রতিদিন বিকেলে সৌদি আরবে ডাটা ট্রান্সফার হচ্ছে। তারা পরিক্ষা করে বুঝতে পারলেন কোন স্পাইওয়্যার দিয়ে কোন ব্যাক্তির ফোনে আড়িপাতছে সৌদি গোয়েন্দারা। তারা একটু খোঁজ নিয়ে সেই মোবাইল ফোনটি ট্র্যাক করতে সক্ষম হন। সেই ফোনটির মালিক সৌদি এক্টিভিস্ট ওমর আবদুল আজিজ। কিন্তু কেন ওমরের ফোনে আড়িপাতা হচ্ছে?
এর উত্তর পেতে হলে কয়েকমাস আগের ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে ফিরে যেতে হবে। যেখানে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে হওয়া এক নারকীয় হত্যাকান্ডে নিহত হন নির্বাসিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগজি। কিন্তু খাশোগজি আর ওমরের মধ্যে সম্পর্কটা কোথায়? সৌদি আরবের রাজ পরিবার,বিশেষত বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের কট্টর সমালোচক ওমর, সরাসরি যুবরাজের অনিয়ম, নিপীড়ন নিয়ে অনলাইনে সরব ছিলেন। সেই তুলনায় খাসোগজি এমন কোন কিছু করেননি। তবে ওয়াশিংটন পোস্টে তার লেখা কিছু আর্টিকেল নিয়ে যুবরাজ ক্ষুদ্ধ ছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু কয়েকটি আর্টিকেলই কি খাশোগজির মৃত্যুর কারণ? না। মূলত একজন সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে বিধি নিষেধের ভয়ে যা বলতে বা লিখতে পারতেন না। সেসব তথ্য তিনি ওমর আবদুল আজিজের সাথে শেয়ার করতেন। এমনকি ওমর যাতে তার অনলাইন কার্যক্রম চালাতে পারেন,সেজন তাকে অর্থ সাহায্যও করে ছিলেন। মূলত তারা দু’জনেই সৌদি সরকারের ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লংঘন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু কে সেই বিশ্বাসঘাতক,যে তাদের দু’জনের মধ্যকার এই সম্পর্ক ফাঁস করে দিয়েছে? যার জন্য জামাল খাশোগজিকে প্রাণ দিতে হলো।

আসলে পুরোটা সময় বিশ্বাসঘাতককে পকেটে নিয়ে হাঁটছিলেন ওমর। তার অজান্তেই তার মোবাইলে ফোনে বাসা বেঁধেছে একটি বিশেষ সফটওয়্যার। যাকে স্পাইওয়্যারও বলা হয়। যার মাধ্যমে শুরু থেকেই তার আর খাশোগজির সব গতিবিধি, কথোপকথন ও ব্যাক্তিজীবনের অনেক তথ্য সৌদি আরবে পাচার হয়ে গেছে। সেই কুখ্যাত স্পাইওয়্যারটির নাম পেগাসাস।
গ্রীক পুরানের ডানাওয়ালা ঘোড়া পেগাসাসের নামে এই স্পাইওয়্যারটির নামকরণের কারণ,এটি একটি ট্রোজান হর্স ভাইরাস। যা আপনার অজান্তেই আপনার ফোনে কোন লিংক,মেসেজ এমনকি মিসকলের মাধ্যমে ইন্সটল করে দিতে পারবে এর ব্যবহারকারী। আপনার অজান্তেই পাচার হতে থাকবে ফোনের সব তথ্য। স্পাইওয়্যারটি তার কাজে বিশ্বসেরা। এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইজরায়েলের এনএসও সাইবার ফার্ম। বিশ্বব্যাপি স্পাইওয়্যার বিক্রিতে ইজরায়েলের কুখ্যাতি অনেক আগ থেকেই ছিল। তবে খাশোগজী হত্যার কয়েক মাস পর,এই তথ্য সেখানে নতুন মোড় আনে।

সিটিজেন ল্যাব শুধু সৌদি আরবই নয়। আরব আমিরাত, পেরু,ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে মেক্সিকোর কুখ্যাত মাদক মাফিয়াদের কাছেও এই সফটওয়্যার বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে। এই গুপ্ত পোগ্রামটির নির্মাতারা দাবি করেন, পেগাসাসের মাধ্যমে অপরধা ও সন্ত্রাস দমনে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সফলতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বাস্তবে এটি যতটা না সন্ত্রাস দমনে ব্যবহৃত হয়েছে।তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়েছে, ব্যাক্তিগত তথ্য পাচার,ভিন্নমত দমন ও মানবাধিকার দমনে। অনেক দেশের রাজনৈতিক,অরাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব থেকে শুরু করে মানবাধিকার কর্মীদের উপর নজরাদিরতে ব্যবহৃত এই স্পাইওয়্যারটির কারণে, এরই মাঝে খাশোগজি ছাড়াও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও হুইসেল ব্লোয়ার প্রাণ হারিয়েছেন।
সিটিজেন ল্যাব জানায়, এই স্পাইওয়্যারটি এন্ড্রয়েড ও আইওএসের সবগুলো ভার্সনেই কার্যকর। এটি ব্যবহারকারীর ফোন থেকে গোপনে তথ্য পাচারের পাশাপাশি তার অবস্থান নির্ণয়। ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে গোপনে ছবি তোলা কিংবা কথা রেকর্ড করতে পারে। যদি কোন কারণে কেউ সন্দেহ করে আর তা যদি স্পাইওয়্যারটি টের পায়। তবে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাথে সাথে উক্ত ডিভাইসে তার থাকার সমস্ত প্রমাণ মুছে ফেলে। যে কারণে, এই স্পাইওয়্যারটি দীর্ঘদিন ধরে গোপনে তার কাজ চালিয়ে আসছিল। সিটিজেন ল্যাবের তথ্যমতে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত ২০১৩ সাল থেকে এই স্পাইওয়্যারটি ব্যবহার করে আসছে। যদিও তখন আরব আমিরাতের সাথে ইজরায়েলের কোন কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। আর সৌদি আরবের সাথে তো এখনও নেই!
পেগাসাস সম্প্রতি আবারও আলোচনায় এসেছে ভারতের মাধ্যমে। বিশ্বব্যাপি ১৭টি সংবাদ মাধ্যম থেকে আসা সাংবাদিকদের একটি দল, পেগাসাসের ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। সেখানে তারা বিশ্বব্যাপি নজরদারির মধ্যে থাকা ৫০,০০০ ফোন নম্বর উদ্ধার করে। যার মধ্যে ৩০০টি ফোন নম্বরের ব্যবহারকারী ভারতীয়। যার মধ্যে আছেন ভারতের বিরোধদলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, দলিত নেতা, সংখ্যালঘু নেতা, বিচারকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।

তালিকায় সবার উপরে থাকা কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এর প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, তিনি টের পেয়েছিলেন তার ফোনে কেউ আড়িপাতছে। এর আগে ৫ বার তার ফোনটি হ্যাক করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরই আছেন পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি। নির্বাচন কুশলী প্রশান্ত কিশোরসহ অনেক রাজনীতিবিদ। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ১১ জন নারী আইনজীবী। তবে সবচেয়ে আলোচিত আড়িপাতার ঘটনাটি হলো,ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গোগই এর একজন স্টাফের। উল্লেখ্য এই রঞ্জন গোগই ফ্রান্স থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর জন্য কেনা রাফায়েল বিমান ক্রয়ে দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান করছিলেন। এরই মাঝে তার সেই স্টাফ গোগই এর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনেন। আর তার কিছুদিন পরই তদন্তের সমাপ্তি ঘটিয়ে ভারত সরকারকে রাফায়েল বিমান কেনার জন্য গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিলেন গোগই। অনেকেই তখন দাবি করেছিলেন গোগইকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন এসেই যায়,তবে কি এর পেছনে পেগাসাস দায়ী?

মজার বিষয়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন যখন তার ফোনে পেগাসাসের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। তখন তিনি এই বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতেও পেগাসাস নিয়ে তোলপাড় চলছে। এমনকি নির্মাতা দেশ ইজরায়েলও একটি তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে এই নিয়ে এখনও কোন বিবৃতি বা তদন্ত শুরু করেনি ভারত সরকার। বরং বিজেপির আইটি সেলের কর্মীরা দাবি করছে এটি মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। একমাত্র পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য সরকার একটি বিচারবিভাগীয় অনুসন্ধান শুরু করেছে।
এসপিওনাজের জগতটা সবসময় নোংরামি, শঠতা আর বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা। কিন্তু পেগাসাস অতীতের সব শংকাকে ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের ব্যাক্তিগত বলে আজ কিছু নেই। অবৈধ রাষ্ট্র ইজরায়েল কি কোন প্যাণ্ডোরার বাক্স খুলে দিল?