এমিলিয়ানো মার্টিনেজঃ উপেক্ষা দিয়ে শুরু করে “আর্জেন্টাইন বাজপাখি” হলেন যে খেলোয়াড়

কোপা আমেরিকায় শেষ অবধি টাইব্রেকারে সেমিফাইনালে কলম্বিয়াকে হারিয়েছে আর্জেন্টিনা। উঠে গেছে ফাইনালে। যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষায় ব্রাজিল। যেন রোমাঞ্চকে ছাড়িয়ে থ্রিলারে পরিনত হওয়া কোনো ঘটনা! পুরো ঘটনার নায়ক একজন। এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। জাতীয় দলের হয়ে যার অভিষেকের অপেক্ষাটা বাড়ছিল অনেক দিন ধরেই। চলতি কোপার আগেই দরজায় এসে হাজির হলো সুযোগ। সেটিকে কী দারুণভাবেই না কাজে লাগালেন অ্যাস্টন ভিলা গোলরক্ষক। এবার কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে এসে নিজেকে প্রমাণ করেছেন এই গোলরক্ষক।
ম্যাচের পর দলের গোলরক্ষকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মেসি বলেন, ‘আমাদের দলে এমি রয়েছে, যে একটা ফেনোমেনন। আমরা ওর ওপর আস্থা রেখেছিলাম। ফাইনালে পৌছনোর পাশপাশি টুর্নামেন্টের সবক’টি ম্যাচ খেলার আমাদের লক্ষ্যও পূর্ণ হল।’
এখন খ্যাতির শিরোনামে থাকলেও মাত্র ১৮ মাস আগেই ফুটবলবিশ্বের খুব কম লোকই এমি মার্টিনেজ নামটির সঙ্গে পরিচিত ছিল। তবে একটি দুর্ভাগ্যজনক চোট ও দুরন্ত মানসিকতাই মোড় ঘুরিয়ে দেয় মার্টিনেজের। প্রায় এক দশকের ও একাধিক অসফল লোনের পর আর্সেনাল গোলরক্ষক বার্নড লেনোর আঘাতে ভাগ্য খোলে মার্টিনেজের।
চলুন জেনে আসি মার্টিনেজের জীবনের যত উত্থান পতন।
১৯৯২ সালের ২ সেপ্টেম্বর, আর্জেন্টিনার মার দেল প্লাটা তে জন্মগ্রহণ করেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। তার পুরো নাম দামিনি এমিলিয়ানো মার্টিনেজ রোমেরো। তিনি একজন আর্জেন্টাইন পেশাদারী ফুটবলার। বর্তমানে তিনি প্রিমিয়ার লিগ অস্টন ভিলা এবং আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের একজন গোলকিপার। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠা আসা এই খেলোয়ার খুব ছোট বেলাতেই নিজের ভাগ্য বদলানোর শপথ নেন।
মার্টেনেজ তার কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ‘ইন্ডিপেন্ডিয়েন্ট’ এর হয়ে খেলে। ২০১১ সালের জুন মাসে, নাইজেরিয়ার বিপক্ষে খেলার জন্যে অস্কার উস্তারির পরিবর্তে আর্জেন্টিনা সিনিয়র স্কোয়াড এ ডাক পড়ে মার্টেনেজ এর। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ৯ এবং ১৩ অক্টোবর, জার্মানি এবং ইকুয়েডর এর বিপক্ষে খেলার জন্যে পুনরায় ডাক পড়ে তার।
২০১২ সালে, এমিলিয়ানো যখন আর্সেনালে যোগ দিয়েছিলেন তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। কৈশোরের গন্ধও ততক্ষণে যায়নি গা থেকে। কিন্তু সেই বয়সে ক্লাব থেকে পেলেন একরাশ উপেক্ষা। সেই যে শুরু এরপর তিনি একের পর এক মৌসুম ধারে কাটিয়েছেন অক্সফোর্ড ইউনাইটেড, শেফিল্ড ওয়েন্সডে, রটারডাম, উলভারহ্যামটন, গেটাফে, রিডিংয়ের মতো ক্লাবে।
কিন্তু ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, মার্টিনেজ ২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চুক্তিতে সহকর্মী প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব অ্যাস্টন ভিলায় স্থানান্তরিত হন। এক প্রকার বিক্রি ই করা হয় তাকে। অনেক উপেক্ষার পরে,অনেকের উপদেশ না মেনে আর্সেনাল থেকে অ্যাস্টন ভিলায় সই করেন তিনি।
সেখানে যোগ দেওয়ার পর আর্জেন্টাইন এই গোলরক্ষক স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আর্সেনালের ওপর কিছুটা ক্ষোভ ঝেরেই বলেছিলেন, ‘এখনও আর্সেনালের সব কিছু ভালোবাসি আমি এবং খেলাও দেখি তাদের। তবে আমার মনে হয়েছিল, আমাকে যেমন বিশ্বাস করার কথা তেমন বিশ্বাসটা তারা আমার ওপর রাখত না।’
কিন্তু অ্যাস্টন ভিলায় এসে একের পর এক দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে নজর কেড়ে নেন মার্টিনেজ।
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, মার্টিনেজ শেফিল্ড ইউনাইটেডের বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতে লন্ডস্ট্রামের কাছ থেকে পেনাল্টি বাঁচিয়ে ভিলার হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এছাড়াও সবজায়গায় ই তিনি রেখেছেন কৃতিত্বের ছাপ। দারুণ সব পারফর্ম্যান্স উপহার দিয়েছেন অ্যাস্টন ভিলার ভঙ্গুর রক্ষণের পেছনে থেকে।
২০২১ সালের ৩ জুন, ‘২০২২ ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফিকেশন’ এ চিলির বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র হওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষেক ঘটে মার্টিনেজ এর।
১৪ জুন, এস্টেডিও ওলাম্পিকো নীল্টন সান্টোস- এ ২০২১ কোপা আমেরিকা ফুটবল ম্যাচে একই দেশের বিপক্ষে একই ফলাফলে প্রতিযোগিতামূলক অভিষেক হয় মার্টিনেজ এর। ৫৭ মিনিটের সময় তিনি আর্টুরো ভিদালের কাছ থেকে একটি পেনাল্টি বাঁচিয়েছিলেন, যদিও এডুয়ার্ডো ভার্গাসের ছুড়ে আসা পেনাল্টি বাঁচাতে ব্যর্থ হন তিনি।
তবে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকা ফুটবলে সুযোগ পেয়েই নিজের জাত চেনাচ্ছিলেন তিনি। একের পর এক ক্লিনশিট রাখছিলেন, আর্জেন্টাইন রক্ষণের শেষ প্রহরীর দায়িত্বটা পালন করেছিলেন ভালোভাবেই।
তবে জীবনের সবচেয়ে বড় চমক দেখান এই বছরের ৬ জুলাই। কোপা আমেরিকা ২০২১ এর সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার খেলা টাইব্রেকারে গড়ালে সেখানে নিজের জাত চেনান অ্যাস্টন ভিলায় খেলা এই গোলরক্ষক। টান টান উত্তেজনা। শেষ দুটো পেনাল্টি শুটআউটে জেতেনি দল।
কিন্তু সকল উদ্যেগ তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে ৩-২ পেনাল্টি শ্যুটআউটে জয়ের লড়াইয়ে মার্টিনেজ তিনটি পেনাল্টি বাঁচায়। সেই সাথে আর্জেন্টিনার জয়ের পথ প্রশস্ত করেন তিনি। মাত্র গুটিকয়েক ম্যাচের পর তিনিই আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে পৌছে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করলেন।
চিত্রঃ কলোম্বিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি বাঁচাচ্ছিলেন মার্টিনেজ
তবে এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। আগামীকাল ১১ জুলাই, কোপা আমেরিকার ফাইনালে নেইমার, রিশার্লিসন, ফিরমিনোদের ঠেকানোর কাজটা এখনো বাকি। সেটা ঠিকঠাক করে দিতে পারলেই ২৮ বছরের শিরোপার আক্ষেপ ঘুচে যাবে আর্জেন্টিনার।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়