নোয়াম চম্স্কিঃ আধুনিক ভাষাতত্ত্বের জনক

নোয়াম চম্স্কি একজন আমেরিকান দার্শনিক, ভাষাবিদ, ইতিহাসবিদ, মনোবিজ্ঞানী, সামাজিক সমালোচক, এবং রাজনৈতিক কর্মী। চম্স্কির কাজ যে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে তা হল, ভাষাবিজ্ঞান এবং ভাষা অধ্যয়ন। যে কারণে তিনি “আধুনিক ভাষাতত্ত্বের জনক” হিসাবে ও পরিচিত।
নোয়াম চম্স্কি ১৯২৮ সালের ৭ই ডিসেম্বর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়া শহরে এক মধ্যবিত্ত আশকেনাজি ইহুদী অভিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ণনাম আভ্রাম নোম চম্স্কি। তার বাবার নাম উইলিয়াম চম্স্কি, যিনি এক হিব্রু পণ্ডিতের সন্তান ছিলেন এবং তার মায়ের নাম এলজি চম্স্কি। ২ ভাইয়ের মধ্যে চম্স্কি ছিলেন বড়।
নোয়াম চম্স্কি ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ডিউইয়েট ওকলেন কান্ট্রি ডে স্কুল এবং ফিলাডেলফিয়ার সেন্ট্রাল হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। যেখানে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। পেনসিলভেনিয়ায় জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও মাত্র ১৩ বছর বয়সেই চম্স্কি নিজেই নিউ ইয়র্কে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণ করা এবং নতুন বই অর্জন করা।
১৯৪৫ সালে ১৬ বছর বয়সে, চম্স্কি পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। চম্স্কি হ্যারিসের টিটলেজের অধীনে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং হ্যারিসের পরামর্শ অনুসরণ করে তিনি নেলসন গুডম্যান এবং নাথান সালমন দ্বারা শেখানো দর্শনশাস্ত্রে ভর্তি হন, যা তার দৃষ্টিভঙ্গি আরও সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করে।
পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে, পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে ডক্টরেট সনদ লাভ করেন তিনি। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী গবেষক হিসেবে কাজ করেন চম্স্কি। যেখানে তিনি তাঁর পিএইচডি এর গবেষণার কাজ করছিলেন।
১৯৫৫ সালে তিনি এমআইটিত (ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি) বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ও জার্মান ভাষার প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে, তিনি সেখানকার ভাষাবিজ্ঞানের ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক পদ লাভ করেন। এছাড়াও ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত, তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত, চম্স্কি নিউ জার্সির প্রিন্সটনের ‘ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি’ তে একটি জাতীয় বিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের সহযোগী ছিলেন।
বর্তমানে তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং একই সাথে ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনা নামক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। যদিও তিনি মূলত একজন গবেষক ও প্রচারক। আজ অবধি, তিনি ভাষা, যুদ্ধ, মিডিয়া এবং রাজনীতির মতো বিষয়গুলিতে প্রায় দেড় শতাধিক বই লিখেছেন। তদুপরি, তিনি লিবার্টেরিয়ান সমাজতন্ত্র এবং অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিজমের অন্যতম প্রধান প্রকাশক।
১৯৫৭ সালে, চম্স্কি তার “সিন্ট্যাকটিক স্ট্রাকচার্স” গ্রন্থে “রূপান্তরমূলক উৎপাদনশীল ব্যাকরণ” নামক তত্ত্বটির অবতারণা করেন। অনেকের মতে, এই তত্ত্বটি আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে এক “বিপ্লবের” সূচনা করে। এছাড়াও চম্স্কি রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতির উপর তথাকথিত মার্কিন “অর্থনৈতিক অভিজাতদের” ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্লেষণ করেন; যার সুবাদে তিনি বিশ্বব্যাপী অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগী অর্জন করেন।
১৯৪৪ সালে চমস্কি ক্যারল ডরিস স্ক্যাটজের সাথে প্রেমের সম্পর্ক শুরু করেছিলেন, যাকে তিনি শৈশবকাল থেকেই চিনতেন। তারা ১৯৪৯ সালে বিয়ে করেছিলেন। হার্ভার্ডে চম্স্কির ফেলো হওয়ার পরে, এই দম্পতি বোস্টনের অলস্টন অঞ্চলে চলে গিয়েছিলেন।
১৯৬২ সালে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূত্রপাতের পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের ভূখণ্ড উপনিবেশ স্থাপনের যে প্রচেষ্টা বলে মনে করেছিল তার সমালোচনা করে চম্স্কিও জনগণের বিতর্কের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবেও কাজ শুরু করেছিলেন। পরবর্তী বছরগুলিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিরোধিতা করার কারণে চম্স্কিকে অসংখ্যবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল; কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেভাবে তার খ্যাতি বাড়তে থাকে, এমআইটিতে অধ্যাপক হিসাবে তিনি কখনই তার পদ হারাননি।
একজন গবেষক ও লেখক হিসাবে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে নোয়াম চম্স্কি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পরিমাণে রচনা প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. লজিকাল স্ট্রাকচার অব লিংগুস্টিক থিওরি (১৯৫৫).
২. ট্রান্সফরমেশনাল এনালাইসিস (১৯৫৫).
৩. মডুলার অ্যাপ্রোচ টু দ্য স্টাডি অব দ্য মাইন্ড(১৯৮৪).
৪. কারেন্ট ইস্যুজ ইন লিংগুস্টিক থিওরি (১৯৬৪).
৫. দি মডেলস ফর দ্য ডেসক্রিপশন অব ল্যাংগুয়েজ (১৯৫৬).
৬. হিউম্যান রাইটস এন্ড আমেরিকান ফরেইন পলিসি (১৯৭৮) ইত্যাদি।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়