পরবর্তী চীন হবার পথে কতটুকু এগিয়েছে বাংলাদেশ?

৬০’র দশকে এশিয়ার ৪টি দেশকে প্রথমবারের মত ‘টাইগার ইকোনমি’র তকমা দেয়া হয়। দেশগুলো হলো,দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং,তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুর। মূলত এশিয়ার সংস্কৃতিতে বাঘের গুরত্ব ও দেশগুলোর দ্রুতগামী অর্থনীতির মধ্যকার সম্পর্ক প্রকাশ করতে এই দেশগুলোকে এমন নামে অভিহিত করে পশ্চিমা মিডিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বদলে যাওয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় কেউ আশা করেনি,পিছিয়ে পড়া এশিয়ান দেশগুলো এত দ্রুত অগ্রসর হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে,এই ৪টি দেশ দ্রুত শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যায়। আজ হংকং ও সিঙ্গাপুরকে পৃথিবীর গুরত্বপূর্ণ ফাইন্যান্সিয়াল হাব হিসেবে ধরা হয়। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান নিজেদের টেক ইন্ডাস্ট্রিকে বহুদূর নিয়ে এসেছে। ১৯৯৭ সালে অর্থনৈতিক মন্দার পরও তারা টিকে আছে।
গত কয়েক বছর ধরে,বিশ্বব্যাংক,আইএমএফ ও অন্যান্য অর্থনীতি বিষয়ক সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে সম্ভাব্য টাইগার ইকোনমি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের লক্ষ্য কি শুধুই কোরিয়া,তাইওয়ানের মত টাইগার ইকোনমি হওয়া?না তার চেয়ে বেশি কিছু? বাংলাদেশ কি পারবে, কোরিয়া,সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে চীনের মত পরাশক্তিতে পরিণত হতে?

১৯৭৯ সালে চীন যখন তার সাংস্কৃতিক বিপ্লব থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। তখন দ্রুতগতিতে তার শিল্পায়ন শুরু করে। এক্ষেত্রে অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোর মত চীনেরও সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল,তার সস্তা শ্রম। সেসময় যখন চীনে ব্যাক্তিগত ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে,তখন সস্তা শ্রম বাজার ও উচ্চ জনসংখ্যা চীনের জন্য আর্শীবাদ হয়ে উঠে। চীন দ্রুত শিল্পকারখানার একটি বিশাল নেটওয়ার্ক বানিয়ে ফেলে। চীনা ব্যবসায়ীরা নতুন প্রযুক্তি সৃষ্টির বদলে,উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তি নকল করা শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে চীনা সরকার নিজ উদ্যোগে প্রযুক্তি বিনিময় চুক্তি করে নিজেদের অর্থনীতির ভীত মজবুত করতে থাকে। সস্তা শ্রম ও নিম্ন মানের প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে চীন নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলে। বিশ্লেষকদের ভুল প্রমাণ করে দিয়ে চীনা পণ্যগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বাজার দখল করে নেয়। ফলে দ্রুত চীনের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করে। ২০০১ সালে চীন যখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয়। তার কিছু আগ থেকেই সস্তার শ্রম ও অবকাঠামোগত সুবিধার জন্য, বিভিন্ন দেশের,বিশেষ করে মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের কারখানাগুলো চীনে স্থানান্তর শুরু করে। ফলে চীনের বিপুল জনগোষ্ঠি যেমন কর্মসংস্থান পায়,তেমনি চীনে বিনিয়োগের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এছাড়া এক পার্টি ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক দেশ হবার কারণে,চীনে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ বিরল।

একই ভাবে বাংলাদেশও বর্তমানে প্রায় একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ৯০’র দশক ও তার শেষভাগে উচ্চ জনসংখ্যার হারের কারণে,এই মুহুর্তে বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশই তরুণ। ফলে বাংলাদেশে শ্রমিকের অভাব হয় না।৮০’র দশকের শেষদিকে কোরিয়ান একটি কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশে যৌথ বিনিয়োগে একটি তৈরি পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।সেসময় বাংলাদেশে এধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা সামনে এসে পড়ে। কারণ,স্বাধীনতার ১ দশক পর বাংলাদেশের অবকাঠামো তেমন উন্নত ছিল না। এছাড়া কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ও কাস্টমসে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সামনেই এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার মডেল ছিল।এবং দ্রুত কোরিয়ার আদলে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক ক্ষাতে একটি ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এছাড়া বাংলাদেশ এখনও স্বল্পোন্নত অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায়, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পায়। যা প্রতিযোগিতায় তাদের টিকে থাকতে সাহায্য করছে। এবং এটি ২০২৪ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চ জিডিপির রহস্য মূলত সস্তা শ্রম আর তৈরি পোশাক খাত। বাংলাদেশের প্রধান ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর চোখে তৈরি পোশাক কারখানা বানানোর জন্য বাংলাদেশের বিকল্প খুব কম দেশই আছে। এমনকি এই শিল্পে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভিয়েতনামের থেকেও কম মজুরি পায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা।
তবে সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশকে চীনের মত উন্নত হতে হলে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো,অবকাঠামো। বাংলাদেশ এখনও অবকাঠামোগত দুর্বলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বল্পতা, সড়ক ও রেল যোগাযোগে দুর্বলতা। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার জন্য বেশকিছু মেগাপ্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা,প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে অধিকাংশ প্রজেক্ট সময়মত শেষ হয়নি।

তাই বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও তৈরি পোশাক খাতের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে বড় ধরনের কোন শিল্প গড়ে উঠেনি।তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রায় ১০০টি শিল্পাঞ্চল তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যার অনেকগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে। এসব শিল্পাঞ্চলের কাজ শেষ হলে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছেন সবাই। এছাড়া বাংলাদেশ তার শিল্পায়নের অংশ হিসবে টেক ও আইটিখাতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা হল,এই খাতের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল বাংলাদেশের আছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশ আইটি বিষয়ে পড়াশোনা করছে। এবং এদের অনেকেরই বিশ্বের অনেক নামিদামি টেক জায়ান্টদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
তবে আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা বাংলাদেশকে সামনে মোকাবেল করতে হবে। আর তা হল,জলবায়ু পরিবর্তন। প্রতিবছর বন্যার কারনে বাংলাদেশের জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ত হয়। তাই এই বিষয়ে বাংলাদেশকে ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এবং কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর সাথে তা নিয়ে বোঝাপড়া করতে হবে।
তাই,সবমিলিয়ে বলা যায়,অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ,যদি তার স্বল্প শ্রম, বানিজ্য সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে পারে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দুর্নীতি রোধ করতে পারে। তবে চাইলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মাথায় রেখেও, আগামি ২০-২৫ বছরের মধ্যে চীনের মত অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হতে পারবে।