ওমের হালিসদেমিরঃ তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান বানচালের নায়ক

১৫ জুলাই, রাত ৮টা, তুরস্কের মানুষ কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলো সারি সারি ট্যাংক ইস্তাম্বুলের রাস্তায় নেমে গেছে। একে একে শহরের বিভিন্ন জায়গায় সেনা টহল শুরু হয়ে গেল। আকাশে টহল দিতে শুরু করলো এফ-১৬ জংগিবিমান আর এটাক হেলিকপ্টার। তুর্কি প্রধানমন্ত্রী একটি টিভি চ্যানেলকে জানালেন,একদল সেনা চেইন অব কমান্ড ভেঙে ক্ষমতা দখল করতে নেমেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কোথায় কেউ জানে না?
কিন্তু একদল সেনা ঠিকই জানে কোথায় আছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। সুদূর আনাতোলিয়ার ঘাটি থেকে হেলিকপ্টারে করে,তারা এখন আঙ্কারার টার্কিশ স্পেশাল ফোর্স হেডকোয়ার্টার দখল করতে আসছে। দলটির নেতৃত্বে আছেন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সেমাহি তারজি। হেডকোয়ার্টার দখল করার পর সেখান থেকে তুর্কি সরকারের বিভিন্ন গুরত্বপুর্ণ ব্যাক্তিবর্গকে গ্রেফতার কিংবা হত্যার পরিকল্পনা আছে তাদের। তাদের একটি দল এর মধ্যেই মারমারা সাগর ঘেষা একটি অবকাশ যাপন কেন্দ্রে হামলা চালাতে শুরু করেছে। যেখানে কিছুক্ষণ আগেও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অবস্থান করছিলেন। তুর্কি সেনাবাহিনীর জেনারেল আকজাকলি অনেকক্ষণ ধরেই অভ্যুত্থান চেষ্টার খবর পাচ্ছিলেন। তার ব্যাক্তিগত গাড়ি প্রেসিডেন্ট ভবনের দিকে যাবার সময় ৩টি সামরিক যান এসে সেটিকে ঘিরে ধরে। তবে জেনারেল এমন কিছু অনুমান করেই,খালি গাড়ি সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অভ্যুত্থানকারী সেনারা জেনারেলকে গ্রেফতার করার জন্য চিরুনী অভিযান চালাচ্ছে। তিনি গোয়েন্দা মারফত খবর পেয়েজেন বিগ্রেডিয়ার তারজি স্পেশাল ফোর্স হেডকোয়ার্টার দখল করতে আসছেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। তার সামনে এই অভ্যুত্থান ঠেকানোর একটা দূরতম সম্ভাবনা আছে। স্পেশাল ফোর্স হেডকোয়ার্টারে তার পরিচিত একজন সেনা আছে। ফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে সেখানে কল দিলেন তিনি। অপরপ্রান্তে কে ফোনটা ধরবে তিনি জানেন। তার নাম স্টাফ সার্জেন্ট ওমের।
“ হ্যালো, জেনারেল আকজাকলি বলছি।”
“ স্টাফ সার্জেন্ট ওমের হালিসদেমির বলছি, স্যার।”
“ তোমার জন্য একটা গুরুত্বপুর্ণ মিশন আছে, মাই সান।”
“ বলুন স্যার।”
“ তোমার বস, বিগ্রেডিয়ার তারজি একদল সেনা নিয়ে হেডকোয়ার্টার দখল করতে আসছে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তোমাকে তা প্রতিহত করতে হবে।তুমি কি বুঝতে পেরেছ?”
“জ্বী,স্যার।”
“ তোমার মৃত্যূ হতে পারে। যা করবে ভেবেচিন্তে করবে।”
“ একজন সৈনিকের জন্য এর চেয়ে গর্বের মৃত্যু আর কিছু হতে পারে না।”
“ গুডলাক, মাই সান।”ফোন কেটে দিলেন আকজাকলি।

এই স্বল্প ফোনালাপেই সার্জেন্ট ওমর বুঝতে পেরেছিলেন তাকে কি করতে হবে। জলদি নিজের ব্যাক্তিগত পিস্তল নিয়ে হেডকোয়ার্টারের পাশে ঝোপে লুকিয়ে গেলেন। একটু পর হেলিকপ্টারে করে বিগ্রেডিয়ার তারজি হেডকোয়ার্টারে এসে পৌছালেম্ন। সংগে একদল সশস্ত্র কমান্ডো। ওমর ঝোপ থেকে বেরিয়ে তাদের সাথে হাটতে লাগলেন। একই ইউনিফর্ম হওয়ায় বাকিরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলো না। বিগ্রেডিয়ার তারজির কাছে এসেই হঠাত নিজের পিস্তল বের করে তারজির মাথায় কয়েক রাউন্ড গুলি চালিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় বাকিরা হতভম্ব হয়ে গেল। বিগ্রেডিয়ার তারজিকে গুলি করেই উলটো দিকে দৌড় দিলেন ওমের। তবে তারজির সাথে থাকা মেজর ফাতিহ শাহিন সাথে সাথেই তার সাবমেশিনগান দিয়ে ওমেরের দিকে ১৫ রাউন্ড গুলি চালিয়ে বসলেন। যার ১২টিই ওমেরের পিঠে বিদ্ধ হয়। তারা সাথে সাথেই বিগ্রেডিয়ার তারজিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়,তবে তিনি এরই মাঝে মারা গেছেন। পিঠে ১২ রাউন্ড গুলি লাগার পরেও সার্জেন্ট ওমের বেঁচে ছিলেন। তখন লেফটন্যান্ট মিহরালি আতমাকা এসে ওমেরের মাথায় গুলি চালিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।পুরো ঘটনাটি সিসিটিভতে রেকর্ড হয়।

সার্জেন্ট ওমেরের পুরো নাম ওমের হালিসদেমির। ১৯৭৪ সালে তুরস্কের নিগদে প্রদেশে,হাসান হুসেন হালিসদেমিরের ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করে। ৭ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৩য়। ১৯৯৯ সালে তুর্কি সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর অনেকদিন পদাতিক কোরে ছিলেন। তুরস্কে কুর্দি গেরিলাদের বিরুদ্ধে অপারেশনের পাশাপাশি তিনি ইরাক ও আফগানিস্তানেও দায়িত্ব পালন করেন। একজন কমান্ডো হিসেবে তিনি বহু জটিল অভিযানে অংশ নেন। যার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি সামরিক পদকে ভূষিত হন। তুর্কি স্পেশাল ফোর্সে যোগ দেয়ার পর কিছুদিন জেনারেল আকজাকলির বডিগার্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাই জেনারেলের কাছের লোক হিসাবে তিনি খুব বিশ্বস্ত ছিলেন।

সার্জেন্ট ওমেরের এই ঘটনার রেশ ছিল ভয়াবহ। শীর্ষ নেতাদের একজনের মৃত্যুতে অভ্যুত্থানকারীরা খেই হারিয়ে ফেললো। ভিআইপিদের গ্রেফতার পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে গেল। প্রেসিডেন্ট এদোয়ানকে গ্রেফতারে ব্যার্থ হওয়ায় তিনি খুব দ্রুতই টিভিতে সমর্থকর রাজপথ দখলের নি্দেশ দিলেন। মুহুর্তেই রাজপথে নেমে এল এরদোয়ান সমর্থকরা। রাতভর সেনাদের সাথে সংঘর্ষে প্রাণ গেল প্রায় ৩০০ সাধারণ নাগরিক ও পুলিশের। পরদিন বিকালের মধ্যেই অভ্যুত্থান পুরোপুরি দমে গেল। অভ্যুত্থানকারিদের কয়েকজন হেলিকপ্টারে করে গ্রীসে পালিয়ে গেল।তুর্কি মিডিয়া জানালো, এই অভ্যুত্থান চেষ্টা নস্যাতের পিছনে অন্যতম কারিগর ছিলেন স্টাফ সার্জেন্ট ওমর হালিসদেমির। তার শেষকৃত্যে তুর্কি সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাসহ কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়। জেনারেল আকজাকলি তার কফিনে চুমু খেয়ে বলেন,“আমার কমান্ডো,তুর্কি জাতি তোমার প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকবে।” তার সম্মানে তুর্কি স্পেশাল ফোর্স হেডকোয়ার্টারে একটি মনুমেন্ট নির্মিত হয়। হেডকোয়ার্টারের যেখানে তিনি মারা গিয়েছিলেন,সেখান পড়ে থাকা রক্তাক্ত অংশটি আলাদা করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তার নিজ এলাকায় তার সম্মানে নিগদে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ওমর হালিসদেমির” বিশ্ববিদ্যালয়।এর বাইরে আংকারাতেও একটি স্কুলের নাম পরিবর্তন করে,তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।