কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সবচেয়ে সফল যে দেশ

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে (কোভিড-১৯) বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ কোটি ১০ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৩১ লাখ ৭০ হাজারের ও বেশি। কোভিড-১৯ দ্বিতীয় দফায় এবার পূর্বের চেয়ে ও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।
গত বছরের শেষদিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ে করোনা ভাইরাস। যাতে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা। প্রায় প্রতিদিনই ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল উহানে যেমন নতুন রোগী বাড়ছে, তেমনি নতুন দেশ থেকে করোনা আক্রান্ত রোগীর তথ্য জানানো হচ্ছে।
ইন্ডিয়ায় প্রতিদিন ৩৫০০০০ এর বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। হাসপাতালে অক্সিজেন এবং স্থানের সংকট দিন দিন ই বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণ জীবন যাপনে ফিরে যাওয়ার জন্যে এক বছরের ও বেশি সময় ধরে সংগ্রাম করে যাচ্ছে মানুষ।
এই নিয়ে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও প্রবল নিয়ম মেনে জীবাণু প্রতিরোধে চমকের পর চমক দেখাচ্ছে একটি দেশ। যেই দেশে একজন মাত্র লোক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এখনও তারা এই ভাইরাস টি কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। তাই তারা ২ সপ্তাহের ভেতর দেশের সর্বাধিক মানুষ কে ভ্যাক্সিন দিয়েছে। বলছিলাম আমাদের নিকটবর্তী দেশ ‘ভুটান’ এর কথা।
পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম ভ্যাকসিন প্রদানকারী দেশ হচ্ছে, ভুটান। এই ছোট্ট দেশ টি অনেক ধনী দেশ কে ও ছাড়িয়ে গিয়েছে এই ব্যাপারে। ৩০ এপ্রিল, ২০২১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভুটানে ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেছে ৪৮০,৪২২ জন। যেখানে প্রতি ১০০ জনে ৬৩ জন মানুষ ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেছে এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রায় ৮৫% ই প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছে।
source: Our world in Data
কিন্তু তারা কিভাবে করলো এই কাজ টি? এক্ষেত্রে যে শব্দটি প্রযোজ্য হবে, সেটি হলো ‘একতা’। দেশজুড়ে মহামারী নিয়ন্ত্রণে দেশটির প্রত্যেক টি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে এসেছিল। হাজারের ও বেশি মানুষ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনই একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ভুটানের রাজধানী থিম্পুর রাস্তায় নেমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিলি করছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং। নিজে হাত ধুয়ে এ কর্মসূচি পালন করছেন এবং সবাইকে স্বাস্থ্য সচেতন হতে আহ্বান করছেন। করোনা প্রতিরোধে এ জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও চর্চা হচ্ছে।
করোনা মহামারির শুরুর পর বাকি বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল ভুটান। মহামারির শুরুতে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকেই উড়োজাহাজের সব ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে ভুটান। কোনো বিদেশি পর্যটককেও দেশে ঢুকতে দিচ্ছে না তারা। তাই ভুটানে করোনা সংক্রমণও হয়েছে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পরে। গত ডিসেম্বরে দেশটিতে প্রথমবারের মত এক নারীর দেহে কোভিড–১৯ উপসর্গ দেখা দেয়।
ডিসেম্বরের শুরু থেকে এই পর্যন্ত ভুটানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১০৮২ জন। যার মধ্যে ৯৬১ জন মানুষ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ জন করোনায় আক্রান্ত মানুষ শনাক্ত হচ্ছে দেশটিতে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত তালিকায় ওপরের দিকে থাকা দেশগুলোর তুলনায় এই সংখ্যা নগণ্য। কিন্তু এতেই ভীত হয়ে পড়েছে ভুটান।
বর্তমানে ভুটানে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে হলে জনসাধারণকে বিশেষ অনুমতি নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া রাজধানী থিম্পু এবং এর পার্শ্ববর্তী জেলা গুলোতে শুধু দোকানে যেতেই মানুষকে বিশেষ চলাচলের অনুমতিপত্র নিতে হচ্ছে।
এত সব নিষেধাজ্ঞার পরেও দেশটির কেউই কারো সম্পর্কে কোনো অভিযোগ করে নি, বিজ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেনি, কিংবা একে অন্যের বিরোধিতা করেনি। প্রত্যেকেই একসাথে কাজ করে যাচ্ছে। গতি, দক্ষতা, ঐক্য এই ৩ টি জিনিস যে কোনো দেশ কে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে, সারাবিশ্বের নিকট এমন প্রমাণ রাখছে ভুটান।
ফলশ্রুতিতে এখন তারা এমন ভাবে জীবন যাপন করছে যেমন একটা জীবনের জন্যে আমরা বেশিরভাগ মানুষ মুখিয়ে আছি।
কিন্তু কেনো এত বড় নিউজ টি নিয়ে কথা বলছে না কেউ? আমরা বেশিরভাগ মানুষ কেন এখনো এই দেশের নাম কিংবা সফলতা সম্পর্কে অবগত নই? এর কারণ, আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বাস করি যেখানে শুধু বড় এবং জনপ্রিয় দেশগুলোকে ই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমরা সবসময় আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মত দেশ গুলোতেই দৃষ্টিপাত করি।
কিন্তু সবসময় বড় বড় দেশ গুলোর ঐক্যের অভাব নিয়ে কথা না বলে, ভুটান সারাবিশ্বের জন্যে একটি উদাহরণ হতে পারে। যে অবিশ্বাস্য হলেও প্রত্যেক মানুষ কে ভ্যাক্সিন প্রদান করা সম্ভব। এছাড়াও ভুটান অন্যান্য অবমূল্যায়িত দেশ গুলোকেও উপস্থাপন করতে পারে। যারা তাদের অসামান্য এবং আশ্চর্যজনক কাজের জন্যে কখনো স্বীকৃত পায়নি।
ভুটান আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, আমাদের লড়তে হবে ভাইরাস এর বিরুদ্ধে, একে অন্যের বিরুদ্ধে নয়। যখন এই সহজ বিষয় টি আমরা সবাই বুঝতে শিখব, শুধু তখন ই আমরা আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে যেতে সমর্থ হব। যেই জীবনে এই ভাইরাস নিয়ে কথা বলার দিন শেষ হবে। যেই জীবনে ফিরে আসবে আগের মত প্রাণচঞ্চলতা।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়