সাদিও মানেঃ অর্থের মাঝে ডুবে থেকেও অর্থের মোহ যার কাছে তুচ্ছ

সাদিও মানে, যিনি তার গতি, সামর্থ্য ও স্বকীয়তায় প্রতিটি মুহুর্তে বিস্মিত করে যাচ্ছেন ফুটবলপ্রেমীদের। বর্তমানে এই গ্রহের সেরা পাঁচজন খেলোয়াড়ের একজন ভাবা হচ্ছে সাদিও মানেকে। তার কনভারশন রেট ২৮ শতাংশ, যা ছাড়িয়ে গিয়েছে মেসি কে ও। নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের এই তারকা। বর্তমানে সপ্তাহে প্রায় ১.৫ লাখ পাউন্ড আয় করেন এই ফুটবলার। কিন্তু তার জীবনের শুরুটা এত সহজ ছিলো না।
আজ চলুন জেনে নেই সাদিও মানের জীবনের যত অজানা কাহিনী।
সাদিও মানে ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল, সেনেগাল এর ছোট্ট গ্রাম বাম্বালি তে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিলো। তাকে স্কুলে পাঠানোর মতো অর্থ ও তার পরিবারের ছিল না। অনেকগুলো ভাইবোন থাকায় তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার চাচার কাছে।
খুব ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের নেশা পেয়ে বসে মানেকে। ফুটবলের প্রতি মানের প্রভূত আকর্ষণ থাকলেও প্রথমদিকে পরিবারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য পাননি তিনি। মানের বাবা ছিলেন একটি স্থানীয় মসজিদের ইমাম। তার পরিবার চেয়েছিল, মানে ধর্মের সাথে সম্পর্কিত কোনো পেশায় নিয়োজিত হোক। যার কারনে ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়তে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছিল তার নিজের পরিবার। সাদিও স্পষ্টভাবেই বলেন, ‘আমি ফুটবলার হই, এটা আমার পরিবারের কেউই চায়নি। বিশ্বকাপের পরে আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে গ্রামে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করতাম। আমি প্রতিটা ম্যাচ জিততে চাইতাম। সবাই আমার প্রশংসা করত, কিন্তু আমার পরিবার আসলে তেমন ফুটবল-সহায়ক ছিল না। তারা আমার জন্য অন্য কিছু পছন্দ করে রেখেছিল।’
কিন্তু ফুটবল থেকে মানেকে কোনোভাবেই সরানো যাচ্ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে পরিবার তার স্বপ্নপূরণে সর্বোচ্চ সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়। মানে জানান, তার যাবতীয় খরচ বহনের জন্য গ্রামের সবাই চাঁদা দিয়েছিল তখন। তার চাচা ও পরিবার জমির ফসল বিক্রি করে পাওয়া অর্থের একটি বড় অংশ খরচ করেছিলেন তার স্বপ্নপূরণে। ডাকারে গিয়ে যে বাড়িতে ওঠেন, সে বাড়ির লোকজন তার একদমই পরিচিত ছিল না। কিন্তু মানের স্বপ্নের কথা শুনে তারা সাহায্য করতে রাজি হয়ে যান, তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
সেনেগালের তরুণ খেলোয়াড় বাছাইয়ের জন্য ‘জেনারেশন ফুট’ নামে একটি অ্যাকাডেমি খুলেছিলেন দেশটির সাবেক খেলোয়াড় ম্যাডি তোরে। এই অ্যাকাডেমিরই একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ হয় সাদিও মানের। যেটি ছিলো মানের জীবনের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। সেনেগালের রাজধানী ডেকারে অনুষ্ঠিত সেই খেলাটি দেখার জন্য ফরাসি ফুটবল ক্লাব মেতজের কয়েকজন স্কাউটও উপস্থিত ছিলেন। খেলায় পরপর চারটি গোল করে মেতজের স্কাউটদের বিস্মিত করেন সাদিও। সেবারই মাত্র ১৬ বছর বয়সে মেতজ স্কাউটদের দলে স্বাক্ষর করেন তিনি।
এই স্বাক্ষরের মধ্য দিয়েই ফ্রান্সে শুরু হয় তার পেশাদার ফুটবল খেলা। পরবর্তীতে ২০১২ সালে, ২০ বছর বয়সে চার মিলিয়ন ইউরোতে তিনি অস্ট্রিয়ার রেড বুল সালজবার্গে যোগ দেন। তিনি যোগ দেওয়ার পর সালজবার্গ অস্ট্রিয়ান বুন্দেসলিগার শিরোপা ছাড়াও ঘরোয়া লিগে দুটি কাপ জেতে। এরপ ১১.৮ মিলিয়ন পাউন্ডে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল সাউদাম্পটনে যোগ দেন তিনি। ২০১৫ সালে, সাউদাম্পটনের মাঠেই অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে মাত্র দুই মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ডের মধ্যেই তিনটি গোল করেন, যেটি এখন পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে দ্রুততম হ্যাটট্রিক হিসেবে অক্ষত আছে। ২০১৬ সালে, ৩৪ মিলিয়ন পাউন্ডে লিভারপুলে যোগ দেন তিনি।
অন্যান্য আফ্রিকান ফুটবলারদের মতো সাদিও মানেও আফ্রিকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রচুর সাহায্য করেন। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে, তার শৈশবের গ্রাম বাম্বালিতে স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য আড়াই লাখ ইউরো দান করেন তিনি। তার বাবা যে মসজিদের ইমাম ছিল, সে মসজিদের সংস্কারের জন্য অর্থ দিয়েছেন তিনি।
সাদিও মানের বয়স যখন প্রায় নয় বছর তখন হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধ হয়ে তার পিতার মৃত্যু হয়। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার বাবা যখন অসুস্থতায় যন্ত্রনা কাতর ছিলেন আমরা তার চিকিৎস্যার ব্যবস্থা করতে পারিনি।’ বর্তমানে তিনি তার দেশ সেনেগালের গ্রামের বাড়িতে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে একটি আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা সম্পন্ন বহুতল হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন যাতে তার বাবার মতো আর কাউকে বিনা চিকিৎসায় মরতে না হয়।
ইসলামের আদর্শে জীবন গড়া এই ফুটবলার উপার্জনের বড় একটি অংশ দেন তার প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থায়, যা থেকে তার দেশ সেনেগালের ও তার গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা হয়। তার গ্রামের দরিদ্র মানুষদের সহায়তা করেন সাধ্যমতো। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সাদিও মানের অনুদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে বম্বালি নামের সেই অখ্যাত গ্রামটি।
ধারনা করা হচ্ছে, বিশ্বখ্যাত এই ফুটবলারের বার্ষিক আয় এখন অন্তত ১০.২ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু সম্প্রতি তার একটি ছবিতে দেখা যায়, সাদিও মানের হাতে থাকা একটি আইফোন ভেঙে প্রায় চৌচির। বোঝাই যাচ্ছে, বহু দিন ধরে এই ফোনটিকে ব্যবহার করছেন তিনি। অসংখ্য ভক্তের প্রশ্ন, প্রতি মিনিটের উপার্জনে বাজারের সবচেয়ে দামি ফোন কেনার ক্ষমতা থাকা স্বত্তেও কেন আরেকটি নতুন ফোন কিনছেন না সাদিও মানে? এই প্রসঙ্গে তিনি জানান, ওই ফোনটি গিনি উইনালডাম নামে এক ডাচ বন্ধু তাকে দিয়েছিলেন। চাইলেই নতুন ফোন কিনতে পারেন তিনি। কিন্তু বন্ধুকে সম্মান জানাতেই তার দেওয়া পুরনো ফোনটিকে এখনো ব্যবহার করছেন তিনি।
সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও তিনি কেন এত সাধারণ জীবন যাপন করেন? ভক্তদের এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে গত বছরের অক্টোবরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘৮/১০টি ফেরারি গাড়ি আমি কেন চাইব? ২০টি ডায়মন্ডখচিত ঘড়ি কিংবা দুটি জেট প্লেন দিয়ে আমি কী করব? এগুলো কি পৃথিবীর কোনো কাজে আসবে? একসময় আমি অভুক্ত থেকেছি, ফসলের মাঠে কাজ করেছি, খালি পায়ে খেলেছি এবং ঠিকমতো স্কুলের পড়াশোনাও করতে পারিনি। এখন আমি মানুষকে সাহায্য করতে পারি। মানুষের জন্য স্কুল তৈরি করে দেওয়া কিংবা তাদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়াকেই আমি বেশি গুরুত্ব দিই। সেনেগালের খুব দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে আমি অনুদান দিচ্ছি। এসব অঞ্চলে প্রত্যেক মানুষের মাসিক আয়ের সঙ্গে আমার দেওয়া ৭০ ইউরো যোগ হচ্ছে। আমার বিলাসী গাড়ির দরকার নেই, আলিশান ঘরের দরকার নেই, ঘুরতে যাওয়া কিংবা প্লেন কেনারও দরকার নেই। এর চেয়ে জীবনে যা পেয়েছি তার কিছুটা অন্যদের দিতে পারলেই আমি তৃপ্ত।’
বর্তমান ক্লাব লিভারপুলকে নিজের পরিবারের মতো মনে করেন মানে। ইয়ুর্গেন ক্লপের কোচিংয়ে প্রতিনিয়তই উন্নতি করছেন, অর্জনের খাতায় যুক্ত হচ্ছে নতুন অনেক কিছু। গত বছরেই লিভারপুলের সাথে একটি লম্বা চুক্তি করেছেন, লিভারপুলেই ক্যারিয়ার শেষ করতে চান অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এই ফুটবলার।
প্রতিটি মানুষের জীবনে সাদিও মানে আদর্শ হয়ে থাকুক আজীবন।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়