বাবুর্চি থেকে যোদ্ধা বনে গিয়েছিলেন যে সোভিয়েত সেনা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতার ইতিহাসে এযাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। ৭৯ বছর আগে ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টম্বরে শুরু হয়ে শেষ হয় ২ সেপ্টম্বর ১৯৪৫।মোট ৬ বছর ১ দিন। আর এ সময়ের মধ্যে বদলে যায় বহু মানুষের জীবন ।মানব সভ্যতার ইতিহাসে সৃষ্টি করে ছিল এক নতুন বাঁকের । কৃষক ,শ্রমিক , শিক্ষক, চিকিৎসক ইত্যাদি শ্রেণী পেশা বাদ দিয়ে সবাইকে যোগ দিতে হয় সেনাবাহিনীতে । এমনি একজন সাধারণ বাবুর্চির বীর সৈনিক হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে হাজির হলাম ।নাম আইভান প্যাভ্লভিচ সিরিদা । যিনি সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন বাবুর্চি হিসেবে আর আবসরে যান লেফটেন্যান্ট পদ মর্যাদায়। জন্ম ১লা জুলাই ১৯১৯ সালে অলেক্সজানড্রিকা গ্রামে (বর্তমান ইউক্রেনের কামেচক্স শহরের নিকট অবস্থিত ) একটি কৃষক পরিবারে। পরবর্তীতে উন্নত জীবনের আশায় সিরিদার পরিবার গ্যালসাইনবভোকা নামের একটি বড় গ্রামে স্থানান্তরিত হয়। কলেজে ভর্তি না হয়ে দোনেস্ক ফুড ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন সিরিদা।

জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন লিডার জোসেফ স্টালিন এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন । আর যুক্তিক কারণও ছিল। উল্লেখ্য ১৯২৫ সালে এডলফ হিটলার তার লিখা ‘মাইন ক্যাম্ফ’ আত্মজীবনীতে রাশিয়া আক্রমণের কথা ব্যক্ত করেন। নভেম্বর ১৯৩৯ অন্য সব যুবকদের মত সিরিদাকে ও জোরপূর্বক রেড আর্মিতে যোগদানে বাধ্য করা হয়।মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদানের পর ৯১নং ট্যাংক রেজিমেন্ট, ৪৬ নং ট্যাংক ডিভিশন এবং ২১ নং যান্ত্রিক সৈন্যদলের বাবুর্চি হিসেবে সিরিদাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারী জার্মান বাহিনী সোভিয়েত – রোমানিয়া সীমন্তে জড় হতে শুরু করে। সেই সাথে জার্মান বিমান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন সীমন্তে সারভেইলেন্স চালানো শুরু করে । স্টালিন ও আসন্ন আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুতি নেয়। ২১ জুন ১৯৪১ পর্যন্ত সোভিয়েত সৈন্যরা খুবই সর্তক অবস্থানে থাকে। পরের দিন সকালে সকল সৈন্যদের একত্রিত করা হয় এবং সেই সাথে সর্তক করা হয় যে কোন ধরনের উসকানিমূলক আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে ।এদিকে সোভিয়েতদের যোগাযোগ অবকাঠামো ছিল ভয়াবহ খারাপ । যে কারণে ফ্রন্ট লাইনের অনেক সৈন্য যুদ্ধের সংবাদ অনেক দেরীতে পেয়েছিল । আবার অনেকে পায়নি। ২২ জুন ভোররাত ৩ টার সময় জার্মান সৈন্যরা সোভিয়েত সীমান্ত অতিক্রম করে। শুরু হয় অপারেশন বারবারোসা । বেসিরভাগ সোভিয়েতবাসী জানত না যে তাদের দেশে কতটা ভয়াবহ যুদ্ধে শুরু হযে গেছে। তারা জানতে পারেন দুপুরের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ভিয়েচেস্লাভ মলোটাভের ঘোষণার পর।

অগাস্ট ১৯৪১ ডিভিনস্ক শহরের (বর্তমান লাটভিয়ার ডাগভপিলস শহর ) কাছে ছিল সিরিদার ক্যাম্প । এক সন্ধায় সৈনিকরা মহড়া ব্যস্ত ।আর সিরিদা ব্যস্ত রাতের খাবার তৈরিতে । হঠাৎ সিরিদা মটরের আওয়াজ শুনতে পেল। প্রথমে ভেবেছিল এটা তার মনের ভুল , কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখল একটি ট্যাংক ক্যাম্পে ঘুরছে। তাখন সে ভাবল আর কত লোকের জন্য তার খাবার তৈরি করতে হবে। পর মুহুর্তে সে বুঝতে পারল এটি সোভিয়েত ট্যাংক নয়। এটা জার্মান ট্যাংক । সিরিদা খাবারের তাবুর পিছনে লুকিয়ে যায়। ট্যাংক থেকে চার জন সৈনিক নামে যারা জার্মান ভাষায় কথা বলতে থাকে । তারা তৈরি করা খাবার খেতে লাগল । এ সব দৃশ্য দেখার পর সিরিদা এক হাতে তার রাইফেল এবংঅন্য হাতে কাঠ কাটার কুঠার নেয়। তারপর তাদের দিকে একটানা গুলি বর্ষণ করে এবং ক্ষিপ্ত গতিতে চিৎকার শুরু করে। জার্মান সৈনিকরা সিরিদার চিৎকার শুনে মনে করল এখানে বিশাল সংখ্যক সৈন্য আছে। তাই তারা ট্যাংকে ঢুকে পড়ল । ট্যাংকে ঢুকে গুলি ছুঁড়তে লাগল ,কিন্তু সিরিদা ট্যাংকের উপরে উঠে গেল। এবং কুঠার দিয়ে ট্যাংকের নলে ক্রমাগত আঘাত করতে লাগল। ট্যাংকের নল এক সময় বাঁকা হয়ে গেল। জার্মান সৈনিকরা ট্যাংক থেকে বের হবার চেষ্ঠা করল। কিন্তু বের হতে পারল না কারণ সিরিদা ট্যাংকের পিপ হোল বাহির থেকে বন্ধ করে দেয়। ক্রমাগত চিৎকার দিয়ে সিরিদা তার কমেডরসদের এন্টি গ্রেনেড আনতে বলতে থাকে । যা শুনে জার্মান সৈনিকরা আত্মসমর্পণ করে। মূলত সেখানে কোন কমেডরস ছিলনা ।সিরিদা ছিল একা । এর মধ্যে ক্যাম্পের কাছে সৈনিকদের ছোট একটি ইউনিট ক্যাম্পে গুলির আওয়াজ শুনতে পায়। কিন্তু তারা ক্যাম্পে পৌঁছানোর পূর্বেই সিরিদা বন্দুকের মুখে তাদের আত্নস্মপর্ন করান । এবং তাদের নিদের্শ দেন একজনকে অন্য জনের সাথে বাঁধার জন্য। মহড়া শেষে ফিরে এসে সিরিদার এ বীরোচিত কাজ দেখে কর্মকর্তাগণ তাকে স্কাউট করল। এ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর একদল সোভিয়েত সেনাকে তাড়া করছিল একটি জার্মান ট্যাংক ।যেই মাত্র ট্যাংক থামল সিরিদা ট্যাংকের উপর উঠে গেল এবং ট্যাংকের মধ্যে গ্রেনেড ছুঁড়ে দিল। ভিতরে থাকা সব সৈনিক মারা গেল । অন্য ট্যাংকটির সৈন্যরা কিছু করার আগেই সিরিদা ঐ ট্যাংকে ঢুকে পড়ল এবং গুলি করে ডজনখানিক জার্মান সৈন্যকে হত্যা করল । আর বাকি সৈনিকদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করল।

এ ঘটনার পর তাকে ৪ নং ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট ,৪৬ নং ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং ফাস্ট শক আর্মির প্লাটুন কমান্ডরের দায়িত্ব দেয়া হয়। শুধু তাই নয় ৭ম ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট এবং ১৮৫ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এর কোম্পানি কমান্ডারে পদোন্নতি দেয়া হয়। ১৯৪১ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি ১৯৪২ সাল পর্যন্ত মস্কো যুদ্ধে অংশ নেয়। ফেব্রুয়ারী ১৯৪২ সিরিদা যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুতর আহত হয়। সুস্থ হওয়ার পর সিরিদা কমান্ড স্টাফ কোর্সের উপর গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে পুনরায় সেনাবাহিনীতে যোগ দান করে । ১৯৪৫ সালে তাকে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্ন্তি করাহয় এবং হিরো অব দি সোভিয়েত ইউনিয়ন পদকে পুরস্কৃত করা হয়।