সাবমেরিনের ভেতরকার রুদ্ধশ্বাস জীবন

পৃথিবীর মানুষের কাছে সবচাইতে রহস্যময় যানের একটি নিশ্চয় চোখে না দেখতে পাওয়া সাবমেরিন যান । নিরবে, নিভৃতে যেকোন সময় শত্রুর অন্তরাত্মায় নিঃশ্বাস ফেলতে পারা এ যানটি সর্বদাই যেকোন শত্রুর কপালের ভাঁজে পরিণত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বাহির থেকে দেখতে খুব সহজ মনে হলেও সাবমেরিন এর ভিতরের জীবন কিন্তু মোটেই সরল নয়। বরংচ বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজের একটি এই সাবমেরিন ক্রুদের জীবন।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নিকট বিভিন্ন মাপের ও বিভিন্ন ক্ষমতার সাবমেরিন থাকলেও এর ভিতরের জীবনযাত্রা কিন্তু অনেকটা একই । আকার অনুযায়ী একটি সাবমেরিনে ৫০ হতে ১৩৫ পর্যন্ত ক্রু থাকে। একটি সাবমেরিন মিশন সাধারণত ৬০ হতে ৮০ দিনের হয়ে থাকে।
সাবমেরিন ক্রুরা সাধারণ ওয়ার্কারদের মত কাজ করতে পারে না। তাদের এমন একটি পরিবেশে কাজ করতে হয় যে পরিবেশে মাসের পর মাস সাধারণ মানুষের জন্য টিকে থাকা অসম্ভব প্রায় বলা চলে।
পানির নিচে জমাট অন্ধকার, একজন নাবিক কে দিন রাতের তফাৎ বুঝতে দেয় না। বাহিরের জগতের সঙ্গে একেবারে বিচ্ছিন্ন গুমোট বদ্ধ পরিবেশে জীবন কাটানোয় এটি শরীর ও মনের উপর মারাত্বক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়াও সামরিক মিশন ত রয়েছেই।
তাই, সারাবিশ্বই সাবমেরিন ক্রু দের খুবই সতর্কতার সাথে বাছাই করে থাকে। একজন ক্রু প্রার্থীকে অসংখ্য পরীক্ষার মাঝ দিয়ে যেতে হয় । লিখিত, শারিরীক, মানসিক, পরীক্ষার পরও দলবদ্ধ ভাবে কাজ করার, অনুশাসন মানার, বিপদের মূহুর্তে মাথা ঠান্ডা রাখার মত হাজারো পরীক্ষা তাদের দিতে হয়।
পরীক্ষায় টিকলে শুরু হয় জলে ও স্থলে’র কঠিন ট্রেনিং। এ সকল ট্রেনিংয়েই সাবমেরিন সংক্রান্ত সকল কিছু নাবিকদের শিক্ষা দেয়া হয়। এতসবেও শেষ নয়, একজন হবু নাবিককে ফাইনাল এপ্রুভালের পূর্বেও তাদের অলক্ষ্যে সামাজিক পরিবেশে কড়া নজরে রাখা হয়। ট্রেনিং শেষে অভিজ্ঞতা অনুসারে এ সকল নাবিকদের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গুরুত্বের সাবমেরিনে পোস্টিং দেয়া হয়।
সাবমেরিনের ভেতর সকলের কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়া থাকলেও সাবমেরিনের ভেতর কোন শ্রেণী বিভাজন নেই। অফিসার হতে ক্রু সবাইকেই যেকোন কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।

সাবমেরিনের ভেতর নাবিকরা নিজদেশের প্রচলিত খাবারই খেয়ে থাকেন। ছোট্ট সুরক্ষিত একটি কিচেন সব সাবমেরিনেই থাকে। ধোয়া ও বাস্প এড়ানোর জন্য রান্না মূলত ইলেট্রিক ওভেন, গ্রিল ও ফায়ারে করা হয়। সব ক্রু’কে অবশ্যই রান্না জানতে হয়।
কাঁচামাল পঁচে যাবে তাই কতদিনের মিশন সে অনুযায়ী ক্যানভর্তী খাবার নেয়া হয়। সাবমেরিনের নাবিকদের সবচাইতে পছন্দের খাবার হয়ে থাকে আইস্ক্রিম, তাই এটি নেওয়াও হয় অধিক হারে।
চারদিকে পানির মধ্যখানে বসবাস করলেও পানির অভাবে ভুগেন সাবমেরিন বাসীরা। বিশুদ্ধ পানি উৎপাদনে প্রচুর শক্তি লাগে তাই পানির অপচয় রুখতে সপ্তাহে মাত্র একদিনই গোসলের সুযোগ পান সাবমেরিন ক্রু’রা। বিশেষ একধরণের জামা-প্যান্ট পরে থাকেন তারা, যার ভেতর ছত্রাক ও ব্যাক্টেরিয়া নিরোধক লাগানো থাকে। তিনদিন পরার পর আবার নতুন জামা-প্যান্টের সেট বের করে নেন।
দাড়ি কাঁটা বা দাত মাজতে কোন সমস্যা না থাকলেও আসল ভয় কমোড কে নিয়ে। সাবমেরিনের কমোড মলমূত্র পাঠায় মূলত বিশেষ একটি ট্যাংকে। একটি ভালবের সাহায্যে নিয়মিত সে মলমূত্রে ভরা ট্যাংক খালি করা হয়। কিন্তু কোন ভাবে ভালবটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তুমুল বিস্ফোরণ করে সমুদ্রের পানি ঢুকতে পারে সাবমেরিনের ভেতরে।

সাবমেরিন ক্রু’দের ডিউটি হয় তিনঘন্টা করে। প্রতি তিনঘন্টা ডিউটির পর ছ’ঘন্টা বিশ্রাম বাধ্যতামূলক । প্রতিটি সাবমেরিনের ভেতরেই ছোটখাটো একটি জিম থাকে যেখানে ট্রেডমিল,স্ট্যাটিক সাইকেল ও অন্যান্য ছোটখাটো সরঞ্জাম থাকে। ফ্রি সময়ে নাবিকরা এখানে এসে এক্সারসাইজ করে যান।
এছাড়াও অবসরে সবাই তাস,দাবা, ভিডিও গেম খেলেন। গল্পগুজব করেন নিজেদের মাঝে অথবা সবাই মিলে ভিডিও প্লেয়ারে সিনেমা দেখে থাকেন।
সাবমেরিন ক্রুদের বেশকিছু অদ্ভূত রীতিও রয়েছে। জানা যায়, সাবমেরিন যেদিন বিষুবরেখা তথা equator পার হয় সেদিন ক্রুদের মধ্যকার সবচেয়ে মোটাসোটা মানুষটিকে নেপচুনের রাজা সাজিয়ে নানা গান, হাসি,ঠাট্রা, মজা করা হয়।
এছাড়াও মিশনের ঠিক মধ্যভাগে steel beach picnic নামক একটি উৎসব উদযাপন করে সাবমেরিন কর্মীরা। সেদিন সাবমেরিনের ডেকে সবাই মিলে উঠে খানা-পিনা, নাচানাচি করে থাকে। খালি গায়ে শার্ট-প্যান্ট পরে সাগরে সবাই মনের আনন্দে ঝাপিয়ে পড়ে। বলাই বাহুল্য, সে সময় ডেক হতে কয়েকজন ক্রু সাব মেশিনগান হাতে কড়া নজরদারি চালান সমুদ্রের জলে যেন কোথাথেকে কোন হাঙর এসে আনন্দে ব্যঘাত ঘটাতে না পারে।
পদে পদে বিপদের হাতছানি, গুমোট পরিবেশে মানসিক হাহাকার, মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ আনন্দ এসব নিয়েই চলতে থাকে সাবমেরিন ক্রু’দের জীবন।
কি বলেন??? আপনিও কি হতে চান এমন রোমাঞ্চকর জীবনের অংশ হতে?
মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ খাঁন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরো পড়ুনঃ-
বাবরি মসজিদের পর এবার ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য জ্ঞানব্যাপী মসজিদঃ- https://cutt.ly/8vtnbMF