মাওবাদী-নক্সাল আন্দোলনঃ ভারতের অভ্যন্তরণে ৫৪ বছর ধরে চলমান এক গৃহযুদ্ধ

প্রাচীন হিন্দু পুরাণ রামায়ণে বিশেষ একটা জঙ্গলের কথা উল্লেখ আছে,দন্ডকারণ্য। দন্ডক নামের এক অসুর সেই জঙ্গলের আদি বাসিন্দা বলে এই নাম তার। আবার অনেকে বলে,দন্ডক রাজ্য নামে অসুরদের এক রাজ্য ছিল সেখানে। মহামতি শ্রী রাম,তার স্ত্রী সীতা আর ভাই লক্ষণকে নিয়ে এই জঙ্গলেই ১৪ বছর বনবাসে ছিলেন। পুরাণের বর্ণনামত সেখানে দৈত্য-দানোর দেখা না পাওয়া গেলেও,আজকের দিনে একদল বিশেষ মানুষ সেখানে আস্তানা গেড়েছে। মাওবাদীরা!
মাওবাদী বা নক্সালবাদীদের উত্থান হয় মূলত ভারতের পশ্চিম বঙ্গের নক্সালাবাড়ি এলাকায়। আদর্শগত দিক দিয়ে তার মাও সেতুং এর অনুসারী ছিলেন।চীনে মাও এর কৃষক বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এর ফলশ্রুতিতেই ১৯৬৭ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে মার্ক্সিস্ট থেকে মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট মতবাদে ভাগ হয়ে যায়।বর্তমানে এই আন্দোলন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ভারত সরকার নক্সালিস্টদের সাথে গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলকে ‘রেড করিডোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। এক হিসেবে বলা হয়, ভারতের মোট ২৯টি রাজ্যর মধ্যে ১৪টিতেই মাও বা নক্সালবাদীদের উপস্থিতি আছে। ভারত জুড়ে ৮৩টি জেলায় নক্সালিস্টদের ব্যাপক তৎপরতা দেখতে পাওয়া যায়।

নক্সালিস্টদের এই উত্থানের পেছনে মূলত দায় ভারত সরকারেরই। ভারতের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোতে পর্যাপ্ত অবকাঠামো উন্নয়নের অভাব,শিক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা আর সর্বপোরি কর্পোরেট মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য এর পেছনে দায়ী। ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনী এসব এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণের নামে ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড চালিয়েছে বলা বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা জানায়। বিশেষত দণ্ডকারণ্য অঞ্চল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় সেখানকার মানুষদের জমির উপর মাফিয়াদের শোণদৃষ্টি পড়ে। একরকম জোর করেই তাদের কাছ থেকে জমি ছিনিয়ে যেতে থাকে সরকার। বাস্তুচূত এসব মানুষ তাদের আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে পায় মাওবাদীদের।
আপাতদৃষ্টিতে মাওবাদীদের একটি বিচ্ছিন্নবাহিনী বলে ভুল হলেও,আদতে তারা খুবই সুশৃঙ্খল একটি গেরিলা বাহিনী। তাদের সামরিক শাখার নাম,পিপলস ওয়ার গ্রুপ বা জনযোদ্ধা বাহিনী। তাদের সংগঠনের ভেতরে বেশ কঠোর নিয়মকানুনের মধ্যে দিয়ে সশস্ত্র ক্যাডারদের গড়ে তোলা হয়। মার্চ করা থেকে শুরু করে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালনা কিংবা গেরিলা অপারেশন পরিচালনায় তাদের দীক্ষিত করা হয়। সাধারণত চোরাই অস্ত্র,বিশেষ করে একনলা বন্দুকই মাওবাদীদের প্রধান অস্ত্র ছিল। তবে ধীরে ধীরে ভারতীয় সেনা কিংবা আধা সামরিক বাহিনীর কনভয় আক্রমণের মাধ্যমে তারা অস্ত্র সংগ্রহ করে। তাদের হামলার প্যাটার্নগুলোও বেশ ভিন্ন। সাধারণত নিরাপত্তা বাহিনীর টহল দলকে অস্ত্রধারী ক্যাডাররা গুলি করে আহত কিংবা নিহত করে। আচমকা হামলায় বিপর্যস্ত সেনারা কিছু বুঝে উঠার আগেই,ক্যাডারদের সাথে থাকা আদিবাসীরা জংগল থেকে দলে দলে দেশীয় অস্ত্র হাতে বের হয়ে তাদের উপর হামলা চালায়। এমনও দেখা গেছে,আহত সেনাদের জ্যান্ত অবস্থাতেই পা কেটে নিয়ে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা। উদ্দেশ্য,সেনাদের পায়ের বুটজোড়া দখল। তাদের হামলার তীব্রতা ২০০২ সালের পর থেকেই বেড়ে যায়। ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মাওবাদীদের ভারতের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীন হুমকি বলে ঘোষণা করেছিলেন।

ভারত সরকারের কাছে এ ধরনের কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি অপারেশন নতুন কিছু নয়। কাস্মীর কিংবা নাগাল্যাণ্ডে তারা বহুদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে লড়াই করে গেছে। তবে অবাক করা বিষয় মাওবাদীদের সাথে এখন পর্যন্ত চলমান যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীকে বেশ ক্ষয়ক্ষতি পোহাতে হয়েছে। তাদের সমূলে দমন করা সম্ভব হয়নি। ভারতের বিশেষায়িত পুলিশবাহিনী সিআরপিএফ,বিএসএফ আর ভারতীয় সেনার যৌথ অভিযানে মাঝেমধ্যে সাফল্য এলেও বড় ধরনের কোন অগ্রগতি হয়নি। বরং মাঝেমধ্যে গেরিলাদের হামলা কিংবা রাস্তায় পুঁতে রাখা আইইডি বিস্ফোরণে বহু সেনা প্রাণ হারিয়েছে। চলতি মাসের ৩ তারিখে,যৌথবাহিনী সদস্যরা মাধভি হিদমা নামের এক মাওবাদী ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে ধরতে অপারেশন চালাতে আসে। কিন্তু তখনই আচমকা আক্রমণে ২২ জন জাওয়ান নিহত হয়।
ভারত সরকার মাওবাদী ঠেকাতে বিশেষায়িত বাহিনী ‘কোবরা’ গঠন করে। বিভিন্ন মাওবাদী নেতার মাথার দাম ঘোষণা করে। যেমন,এই মাধভি হিদমার মাথার দাম ছিল ১০ লক্ষ রুপি। মাধভি হিদমা ভারতের মাওবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বকনিষ্ঠ কেন্দ্রীয় সদস্য। একজন দক্ষ সামরিক কমান্ডার আর ক্ষুরধার বুদ্ধির জন্য তাকে লম্বা সময় ধরে খুঁজছিল কতৃপক্ষ। ভারতীয় গোয়েন্দাদের ধারণা,হিদমা ইচ্ছে করেই,সেদিন বাস্তরের জঙ্গলে নিজের অবস্থান নিয়ে ওপেন চ্যানেলে রেডিও ম্যাসেজ আদান-প্রদান করে। প্রায় ১০০০ সদস্যের যৌথ বাহিনী আসা মাত্রই তাদের এম্বুস করে হিদমার গ্রুপ।

এর বাইরে ভারতীয় কতৃপক্ষ ‘সালওয়া জুডাম’ নামে স্থানীয় আদিবাসীদের নিয়ে একটি মিলিশিয়া গঠন করেছে। তাদের কাজ নিরাপত্তা বাহিনীকে সাহায্য করা। আর মাওবাদীদের থেকে স্থানীয়দের আলাদা করা। তবে এই সালওয়া জুডামকে নিয়েই আছে বিস্তর অভিযোগ। স্থানীয়রা বলেন, যে কোন অভিযান শুরুর আগে,সালওয়া জুডামের সদস্যরা নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে মিলে,গ্রামের বাইরে ঘাঁটি গাড়ে। তারপর সেখানে গ্রামবাসী,নারী-পুরুষ ধরে আলাদা আলাদা স্থানে রাখে। সেসময় গ্রামবাসীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায় তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে ভারত সরকারের ভুল নীতিই মাওবাদীদের এত লম্বা সময় ধরে টিকে রাখতে সাহায্য করেছে। এক জরিপে দেখা যায়,অন্ধ্রপ্রদেশের ৫৮ শতাংশ মানুষ মাওবাদীদের ব্যাপারে পজিটিভ ধারণা রাখেন।
এর বাইরে গোয়েন্দা ব্যার্থতাও মাওবাদীদের উত্থানের অন্য্যতম কারণ। সর্বশেষ, ভারতীয় কর্মকর্তাদের দাবি,চীন মাওবাদী নেতাদের আশ্রয় দেয় আর পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তাদের অস্ত্র দিয়ে থাকে।