
আজ আপনাদের প্রশান্ত মহাসগরের জলবেষ্টিত এক ক্ষুদ্র দীপ দেশের গল্প শোনাব। মাইক্রোনেশিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত এ দেশটি আয়তনে ভ্যাটিকান সিটি ও মোনাকোর পর পৃথিবীর তৃতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে দাঁড়িয়ে আছে। জানলে অবাক হবেন আকারে এতটা ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও মাত্র কয়েক দশক আগেও পৃথিবীর দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল দেশটি। একটি দেশ রাজার হাল থেকেও কিভাবে রাস্তার ফকিরে পরিণত হতে পারে নাউরো নামক দেশটি ব্যাতীত এর চেয়ে ভালো উদাহরণ বোধহয় আর হতে পারে না।
নাউরো’র টাকার খনী হওয়া শুরু হয় মূলত হাজার বছর আগ থেকেই। বহু বছর আগ থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে সামুদ্রিক পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে উঠেছিল নাউরো নামক দেশটি। সামুদ্রিক এসকল পাখিদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য’ই হাজার হাজার বছর যাবৎ জমা হতে হতে উন্নতমানের ফসফেটের টিলায় পরিণত হয়। পাখির বর্জ্য হতে রূপান্তরিত হওয়া এসকল ফসফেটের টিলাই পরবর্তীতে নাউরো বাসীর জন্য টাকার খনিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। এমন একটি দেশ যাতে চাষাবাদ যোগ্য এক ছটাক জমিও নেই সেই দেশটিতেই প্রকৃতি’র অবাক লীলাখেলায় চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পণ্যটি পাওয়া যাচ্ছিল।
১৯০৬ সালের দিকে জার্মানরা প্রথম নাউরো’র এ ফসফেট খনির সন্ধান পায়। সন্ধান পাওয়ার পর হতেই “প্যাসিফিক ফসফেট কোম্পানি” নামে নাউরো হতে ফসফেট উত্তোলন শুরু করে তারা। জার্মানরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তাদের ফসফেট উত্তোলন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা হেরে গেলে নাউরো হতে তারা কতৃত্ব হারিয়ে ফেলে । এরপর সেখান হতে “ব্রিটিশ ফসফেট কমিশন” নামে পুনরায় ফসফেট উত্তোলন শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ী শক্তিরা। সেকালে খনিটি হতে প্রত্যক্ষ লাভ মূলত পেতে থাকে ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এর মত দেশগুলো৷ মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, এত বিশাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটিও নাউরো’র অবস্থার কোন পরিবর্তন আনতে পারে নি।
অবশেষে ১৯৬৮ সালে নাউরো স্বাধীনতা লাভ করলে দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে যায়৷ নাউরো সরকার এবার “নাউরো ফসফেট কর্পোরেশন” নামে পুরোদমে ফসফেট উত্তোলনে মনোনিবেশ করে। উত্তোলিত ফসফেট এবার রফতানি হতে শুরু করে পশ্চিমা নানা দেশের কাছে। জাহাজে পণ্য তোলার উদ্দ্যেশ্যে নাউরো সরকার প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে বিরাট বিরাট আকৃতির ক্রেন নির্মান করে৷ এত সব মহাযজ্ঞের পর সহজেই হাসতে শুরু করে নাউরো’র অর্থনীতি,আসতে থাকে প্রচুর পরিমান অর্থ৷
এমনকি ১৯৭৫ সালেই নাউরো’র সরকারী ব্যাংকে জমা হয় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্বাধীনতার পর এক যুগেরও অর্ধেক সময়ে কোন দেশের এতটা সম্পদের মালিক হওয়া ইতিহাসে নেই বললেই চলে। সে সময়টাতে নাউরোর জনসংখ্যাও ছিল মাত্র হাজার সাতেক। তার মানে সহজেই অনুমেয় নাউরো’র প্রতিটি মানুষের মাথাপিছু আয় স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাত বছরেই আকাশ ছুয়েছিল, এমনকি তারা এতটাই ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল যে তাদের সামনে শুধুমাত্র তেল নির্ভরশীল কুয়েত অবস্থান করছিল। নাউরো’কে সে সময়কার মানুষরা আখ্যা দেয় প্যাসিফিকের কুয়েত নামে। কেননা তেল রাজ্য কুয়েতের মতই পানির মত টাকা আয় সহজ হয়ে গিয়েছিল সেখানে।
কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল শুধু বসে বসে খেলে একদিন রাজার গোলাও ফুরিয়ে যায়। তারা তাদের অর্থ শিক্ষা,চিকিৎসা,ব্যবসা-বাণিজ্যে বিন্যোগ করার বদলে নেমে পড়ে বিনাশকারী বিলাশিতায়। নিজেদের দেশে খাদ্য উৎপাদনের জায়গায় তারা তাদের সকল খাবার বহির্দেশ থেকেই আমদানি করতে থাকে চড়া মূল্যে। সাতটি উচ্চ মূল্যের বোয়িং বিমান কেনে তারা বিদেশ থেকে নানাধরণের পণ্য নিয়ে আসার জন্য। এছাড়াও তাদের অর্থ ব্যাবস্থাপনা ট্রাস্ট করতে থাকে চরম মাত্রায় দূর্নীতি। রাষ্ট্রের টাকায় তারা দেশ-বিদেশে ঘুরে বেরাতে থাকে। অস্ট্রেলিয়া,ফিজির মত প্রতিবেশী দেশগুলোতে এবার তারা বিলাসবহুল হোটেল বানাতে শুরু করে,যাকে ব্যবহার করে সহজেই তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পাচার করা শুরু করে। সহজ ভাষায় বলা চলে দেশটি নানা ভাবে টাকা উড়াতে থাকে।

কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল ফসফেট ত যেকোন সময়েই ফুরিয়ে যেতে পারে, এটি ত অনন্তকাল থাকার মত সম্পদ নয়। কিছুদিনের মাথাতেই তাদের এ অমূল্য সম্পদ শেষ হয়ে গেল। এতদিন রাষ্ট্রের টাকা যাচ্ছেতাই ভাবে উড়ানোর জন্য রাষ্ট্রীয় কোষও তখন ফাঁকা হয়ে পড়েছিল, উপায় না পেয়ে এবার তারা বিভিন্ন দেশের কাছে টাকা ঋণ নিয়ে দেশ চালানো শুরু করে। বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী রাষ্ট্র থেকে মাত্র কিছু’বছরের ব্যবধানেই তারা হাত পাতা ভিখিরি রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এখানেই কিন্তু ধবংসের শেষ হয় নি। অন্য রাষ্ট্র থেকে যে তারা টাকা নিয়েছে সেটাও ত তাদের আবার ফেরত দিতে হবে, কিন্তু তাদের অর্থ উপার্জনের কোন পথ’ত নেই। শেষমেষ বিদেশী এক কনসাল্টেন্সি এজেন্সের বুদ্ধিতে এবার তারা লন্ডনের “ফোর প্লাস টু ব্যান্ড” দ্বারা কনসার্ট আয়োজন শুরু করে। ভাবতে পারেন কতটা নির্বিবেচক হলে কোন রাষ্ট্র তার ভবিষ্যত একটি সঙ্গীত কনসার্টের উপর ছেড়ে দেয়? এ বুদ্ধিও কাজ করেনি মাত্র দু’সপ্তাহের মাঝেই কনসার্ট বন্ধ হয়ে যায়। একইসাথে নাউরু সরকার ফের আরো ৭ মিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝায় পড়ে যায়।
সে ঋণের টাকা ফেরত দেয়ার সক্ষমতা আর ছিলো না নাউরো সরকারের। একারণে অনুষ্ঠানের পেছনে টাকা লাগানো প্রতিষ্ঠানগুলো এবার নাউরো’র সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয় সাথে নাউরো নাগরিকদের ভাগ্যকেও সাথে করে নিয়ে যায়!

এখন কেমন আছে নাউরো প্রশ্নে সেদেশটির তাকালে দেখা যাবে নাউরোর কাছে এখন ২১ বর্গ কিলোমিটার জায়গা রয়েছে, যার কোথাও ফসল আবাদ সম্ভব না। মাত্রাতিরিক্ত খোড়াখুড়ির ফলে যে দেশটির সকল পানি দূষিত হয়ে গিয়েছে। আর সাথে রয়েছে ৭০০০ নাগরিক যারা একটি জেলখানাতেই ফেঁসে গেছে বলা চলে।
৯৭ শতাংশ পুরুশ এবং ৯৩ শতাংশ নারী সেখানটায় স্থুলতার শিকার। এছাড়াও পরিবেশ জনিত বিষাক্ততা, পানির মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ছাড়াও নানাবিধ কারণে দেশটির মানুষ নানা জটিল রোগে ভুগছে। একই সাথে দেশটির সবচেয়ে বড় সমস্যা দাড়িয়েছে সেখানকার ৯০% মানুষই বেকার।
একটা সময় বিশাল প্রতিপত্তির মালিক দেশটিই কালের বিবর্তনে কি করুণ দশায় এসে দাড়িয়েছে।
একইসাথে নাউরো’র ইতিহাস বিশ্ববাসীকে শিখিয়ে দিয়ে গেল কখনো নিজ সম্পদকে স্থায়ী ভাবতে নেই। দূর্নীতি, দূর্বল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যেকোন দেশকে পথের ফকির বানাতে কখনোই দু’বার ভাববে না।
মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ খাঁন(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরো পড়ুন;
টেসলা কিভাবে বিশ্ব কাপাচ্ছেঃ- https://cutt.ly/8clWsYB