ইতিহাসের পাতায় ত্বরাইনের প্রথম যুদ্ধ

১৩ই নভেম্বর,১১৯১ খ্রিষ্টাব্দ, প্রায় ১৫০০০ ঘুরী সেনার সামনের দাঁড়িয়ে আছে দিল্লী,আজমীর আর তার পার্শ্ববর্তী আরো বেশ কিছু রাজপুত গোত্রের সম্মিলিত বাহিনী। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা প্রায় ৫০,০০০। দিল্লী থেকে ১৫০ কিলোমিটার দুরের ত্বরাইনের প্রান্তরে মুখোমুখি হয়ে আছে তারা। যে কোন সময়, তাদের মধ্যে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের সূত্রপাত হবে। তবে তার আগে এই যুদ্ধের পেছনের কারণ খুঁজে আসা যাক।
মুহাম্মদ ঘুরী,ঘুর সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সফলতম শাসকদের একজন। ঘুর সাম্রাজ্য বর্তমান আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পুরো পারস্য সাম্রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত ছিল। প্রায় দেড়শ বছর আগে,গজনীর সুলতান মাহমুদের হাত ধরে ঘুরের শাসকরা ইসলামে দীক্ষিত হন। তবে এক সময় এই ঘুরীরাই গজনবী সাম্রাজ্যকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। মুহাম্মদ ঘুরীর সময় আসতে আসতে,গজনবীদের খুব সামান্যই অবশিষ্ট ছিল। ১১৭৫ সালে মুলতান এবং ১১৭৮ সালে তার পার্শ্ববর্তী আরো কিছু এলাকা দখল করে ফেলার পর গজনবীদের সর্বশেষ অংশটুকুও ঘুরীদের দখলে এসে পড়ে। ১১৮৬ সালে লাহোর দখল করার পর,তাদের সামনে তখন ভারতের দরজা খুলে যায়।

মুহাম্মদ ঘুরীর আসল নাম,শিহাব-উদ-দীন ঘুরী। তবে শাসনভার গ্রহণ করার পর,তিনি নিজেকে মুহাম্মদ ঘুরী বলে পরিচয় দিতেন। অপরদিকে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন, রাজপুতদের ইতিহাসের অন্যতম বীর,পৃথীরাজ চৌহান। পৃথিরাজ ছিলেন রাজপুতদের মধ্যে সবচেয়ে দুধর্ষ চৌহান গোত্রের রাজা। রাজপুতদের মধ্যে তারা নিজেদের অগ্নীবংশী বলে দাবি করতেন। তাদের রাজ্যকে বলা হত,’শতদলপক্ষ’। যা দিল্লী, আজমীর, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাট, উত্তর রাজস্থান জুড়ে বিস্তৃত ছিল। মুহাম্মদ্দ ঘুরী বেশ কয়েকবার চালুক্য রাজ্য আক্রমণ করেন,যা চৌহানদের সীমানায় ছিল। তবে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা শুরু করেন ১১৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে।

যুদ্ধ শুরুর আগে, মুহাম্মদ ঘুরী তার প্রধান কাজী কিয়াম উল মুলক ইবনে রুকুনউদ্দিনকে দিয়ে পৃথ্বীরাজের কাছে পত্র প্রেরণ করেন। যাতে তিনি পৃথ্বীরাজকে আত্মসমপর্ণ করে ঘুর সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য হিসেবে স্থান নিতে আহবান করেন। তিনি একই সাথে ঐ চিঠিতে পৃথ্বীরাজকে ইসলাম গ্রহণ করতে পরামর্শ দেন। স্বাভাবিকভাবেই পৃথ্বীরাজ এই চিঠি প্রত্যাখান করেন। আর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
এর আগে,মুহাম্মদ ঘুরির বাহিনী চালুক্য রাজ্য যা এখনকার উত্তর রাজস্থান,সেখানে বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেন। এই যুদ্ধে ঘুরীর বাহিনীকে আটকে দিতে পৃথ্বীরাজ আশেপাশেরা আরো দুটি রাজপুত গোত্রের কাছে সাহায্য চান। তাকে সাহায্য করতে সেনা পাঠান কনৌজের শাসক জয়চান্দ ও সোলাংকী গোত্র। রাজপুতদের কয়েকটি গোত্রের সম্মিলিত বাহিনী মিলে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০,০০০। তাদের সাথে ছিল ৩০০ হাতি আর ১০০০ খানেক ঘোড়সাওয়ার সেনা। রাজপুত সেনারা ছিল সম্মুখ যুদ্ধে পারদর্শী। অপরদিকে মুহাম্মদ ঘুরীর সেনাবাহিনী ছিল মূলত, একদল ক্যাভিলারি নির্ভর বাহিনী। যারা দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে ঝটিকা আক্রমণ করতে পারদর্শী। একই সাথে তারা দ্রুতগামী ঘোড়ার উপর থেকে তীর মেরে হামলা চালানোর মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা করতো। ১৫,০০০ সেনার মধ্যে অধিকাংশ সেনাই ছিল তীরন্দাজ নয়তো ঘোড় সাওয়ার।

যুদ্ধ শুরুর আগে,মুলতানের তীব্র গরম আর পাহাড়ি পথ বেয়ে চালিয়ে আসতে ঘুরী বাহিনীর ঘোড়াগুলো ক্লান্ত হয়ে যায়। যখন তারা ত্বরাইনের প্রান্তরে পৌছায়,অপরপ্রান্তে চৌহান সেনারা ঘাঁটি গেড়ে বসে পড়েছে। মুহাম্মদ ঘুরী তার সেনাদের ৯টি দলে ভাগ করেন। মাঝখানে ছিল তার ভ্যানগার্ড আর দুইপাশে ছিল দুটি উইং। রাজপুত সেনাদের রণকৌশল সম্পর্কে মুহাম্মদ ঘুরীর ধারণা ছিল না। তিনি প্রথমেই তার একদল তীরন্দাজ পাঠিয়ে রাজপুতদের আক্রমণ করে বসেন। দ্রুতগামী তীরন্দাজদের আক্রমণে শুরুতেই কিছু সেনা হারিয়ে ফেলে রাজপুতরা। তবে এখানে মুহাম্মদ ঘুরী কিছু ভুল করে বসেন। ত্বরাইনের প্রান্তর ঘোড় সাওয়ার বাহিনী বারবার মুভ করে আক্রমণ চালানোর জন্য অনুপযুক্ত ছিল। এটি ছিল সরু একটি জায়গা। একই বিষয় পৃথ্বীরাজও বুঝতে পারেন। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।আর তার আদেশে ক্ষিপ্র গতিতে ঘুরী সেনাদের আক্রমণ করে বসে রাজপুত সেনারা। ঘুরী ভ্যানগার্ডরা দ্রুত সেই আক্রমণ প্রতিহত করে ফেলে। কিন্তু চৌহান সেনাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমেই তাদের শক্তিক্ষয় হতে থাকে। আর পেছনে হটতে থাকে ঘুরী সেনাবাহিনী।

এই সময় মুহাম্মদ ঘুরী নিজে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।সেনাদের মনোবল বাড়াতে তিনি রাজপুত লাইনের কেন্দ্রে থাকা, তাদের প্রধান সেনাপতি,পৃথ্বীরাজ চৌহানের ভাই জয় গোভিন্দের উপর সরাসরি হামলা চালান। জয় গোভিন্দ হাতির পিঠে থাকা অবস্থায় মাথায় প্রচন্ড আঘাত পান। কিন্তু একই সময় এক রাজপুত সেনার বর্শার আঘাতে গুরতও আহত হন,মুহাম্মদ ঘুরী। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার দেহরক্ষী এক সেনা উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়,তাকে ঘোড়ার পিঠে করে পালিয়ে যান। মুহাম্মদ ঘুরী পালিয়ে যেতেই,ঘুরী সেনাদের প্রতিরোধ ভাঙ্গতে শুরু করে। তারা যেই পথে এসেছিল,সেই পথ ধরে পালাতে শুরু করে। পৃথ্বীরাজ চৌহান প্রায় ৪০ কিলোমিটার ধরে,তাদের তাড়া করেন। তবে পাথুরে রাস্তায় তাড়া করার মত বাহিনী তাদের ছিল না। কারণ,ঘুরী সেনাদের ঘোড়াগুলো মধ্য এশিয়ার রুক্ষ প্রান্তরে চলতে অভ্যস্ত। তাই,তারা দ্রুত পালাতে সক্ষম হয়েছিল।
এই যুদ্ধের ফলে,প্রথম দফায় ভারতে ঘুরীদের প্রবেশ ব্যার্থ হয়ে যায়। রাজপুত ঐতিহাসিকরা তাদের জয়কে কয়েকগুণ বড় করে দেখায়। মুহাম্মদ ঘুরী প্রাণে বেঁচে যান। আর প্রতিজ্ঞা করেন,পৃথ্বীরাজ চৌহানকে না হারানো পর্যন্ত নারী অথবা কোন ধরনের বিলাস দ্রব্য স্পর্শ করবেন না। তিনি তার প্রতিজ্ঞা পরবর্তীতে রক্ষা করেন। আর ত্বরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে জয়লাভ করেন।তবে সে গল্প থাকছে আরেকদিন।