বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল ভারতের যে প্রধানমন্ত্রীকে

১৯৬৬ সালের ১১ই জানুয়ারি, রাত ১টা বেজে ২৫, সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছেন ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার। ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠলেন তিনি। একটা বাজে স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মারা গেছেন। তিনি রুমে পায়চারী করতে লাগলেন। এমন সুময় রুমের দরজায় কেউ নক করলো। দরজা খুলে দেখলেন, একজন নারী দাঁড়িয়ে আছেন।তাকে দেখে বললেন,” তোমাদের প্রধানমন্ত্রী মারা যাচ্ছেন।“ কুলদীপ এটা শোনামাত্রই প্রধানমন্ত্রীর জন্য দেয়া ভিলার দিকে ছুটলেন।
যেই মুহুর্তে কুলদীপ স্বপ্ন দেখছিলেন। সেই মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী তার কক্ষের দরজা খুলে বের হলেন। প্রবল কাশির চোটে তিনি ঠিকমত দাঁড়াতে পারছেন না। একহাতে তিনি গলা চেপে আছেন। তার দুই স্টাফকে তিনি কোনোমতে বললেন, ব্যাক্তিগত চিকিৎসক আরএন চুঘকে ডেকে আনতে বললেন। তারা ডাক্তারকে খবর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রীকে তার রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। ডাক্তার চুঘ এসে শাস্ত্রী সাহেবকে পরিক্ষা করতে লাগলেন। তিনি ধারণা করলেন শাস্ত্রী সাহেবের হার্ট এটাক হচ্ছে। তার করার প্রায় কিছুই ছিল না। তিনি কাদতে শুরু করলেন আর বললেন,” বাবুজি, তুমি আমাকে সময় দিলেন না।“ শাস্ত্রীসাহেব রামনাম জপ করলেন আর ডাক্তার চুঘের কোলে মাথা রেখে মারা গেলেন।

কুলদীপ নায়ার ডাচার সামনে এসে থামলেন। তিনি তাকিয়ে দেখলেন, বারান্দায় সোভিয়েত প্রিমিয়ার এলেক্সেই কসিগিন দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি নায়ারের দিকে হাত ইশারা করে জানালেন প্রাধানমন্ত্রী শাস্ত্রী মারা গেছেন। নায়ার ভবনে প্রবেশ করে দেখলেন, ডাইনিং রুমে একদল ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছেন। তারা ডাক্তার চুঘকে শাস্ত্রীর মারা যাবার ব্যাপারে ক্রস এক্সামিন করছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন, প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রী বিছানায় পড়ে আছেন। তার ড্রেসিং টেবিলের উপর এক পানির ফ্লাস্ক পড়ে আছে। ফ্লাস্কের মুখ খুলে সব পানি বেরিয়ে গেছে। খুব সম্ভবত তিনি পানি পান করতে চেয়েছিলেন। কুলদীপ আর আরেকজন স্টাফ মিলে প্রধানমন্ত্রীর গা জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দিলেন। পতাকাটা তার টেবিলের উপর পড়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রী তাসখন্দে আসেন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি চুক্তি করতে। তার সাথে সেসময় সেখানে অবস্থান করছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। প্রধানমন্ত্রীর স্টাফদের মাধ্যমে পুরো ঘটনার বিবরণ নায়ার জানতে পারেন, সেদিন বিকাল ৪টায় চুক্তি শেষ করে প্রধানমন্ত্রী রাত ১০টায় তার ভিলায় ফিরে আসেন। তার জন্য মস্কোয় নিযুক্ত ভারতীয় এম্বাসেডর এমএন কউলের বাসভবন থেকে খাবার সরবরাহ করা হয়। তার ব্যাক্তিগত গৃহপরিচারক রামণাথ জানায়, শাস্ত্রী খুব সামান্যই খেতেন।সেদিন তিনি পালং, ডাল আর কিছু সবজি খেয়েছিলেন। রাত ১১ঃ৩০ এর দিকে তিনি এক গ্লাস দুধ পান করে ঘুমোতে যান। প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে তিনি এক গ্লাস দুধ খেয়ে ঘুমাতেন। রামণাথ তার সাথেই ফ্লোরে ঘুমাতেন। কিন্তু সেদিন তাকে নিজের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলেন শাস্ত্রী। কারণ, পরদিন সকালে উঠে তাদের কাবুলের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হত। প্রধানমন্ত্রীর স্টাফদের কয়েকজন মিলে পরদিনের জন্য লাগেজ গুছিয়ে রাখছিলেন। তখন রাত ১টা বেজে ২০ এমন সময় প্রধানমন্ত্রীর রুম থেকে শাস্ত্রী টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন। বহু কষ্টে তিনি বললেন,” ডাক্তার সাহেবকে ডাকো?” তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলে তিনি বুক চেপে ধরলেন। জগনণাথ নাম করে একজন স্টাফ কাপে করে পানি এনে তাকে পান করান। এরপর যথারীতি ডাক্তার চুঘ সেখানে এসে পৌছান আর প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রী তার কোলে মাথা রেখে মারা যান।

সোভিয়েত কতৃপক্ষ এই ঘটনাকে খুব সিরিয়াসলি নেয়। কেজিবির নাইনথ ডিরেক্টরেট, যাদের মূল কাজ ছিল ভিআইপিদের নিরাপত্তা দেয়া। তারা সাথে সাথে কাজে নেমে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শাস্ত্রীর কাজে নিযুক্ত থাকা সোভিয়েত বাটলার আহমেদ সাত্তারভকে তার ২ জুনিয়র বাটলারশ কেজবির সদস্যারা ধরে নিয়ে আসে। তাদেরকে প্রবল জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়। সেদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাত্তারভ পরে বলেছিলেন,” আমরা সবাই আতংকে কাঁপছিলাম। আমার সামনে বসা এক জুনিয়রের চুল একরাতেই ধূসর হয়ে গিয়েছিল। আজও আমি সেদিনের কথা ভেবে শিউরে উঠি।“ সাত্তারভ জানান সেদিন আরও একজন ব্যাক্তিকে সেখানে ধরে আনা হয়। তারা ভেবেছিল, এই ব্যাক্তিই প্রধানমন্ত্রীর খাবারে বিষ দিয়েছিল। লোকটির নাম জান মুহাম্মদ। জান মুহাম্মদ ছিলেন এম্বাসেডর কউলের বাবুর্চি। শাস্ত্রী সাহেবের সেই রাতের খাবার তিনিই বানিয়েছিলেন।
শাস্ত্রীর মৃতদেহ যখন দিল্লী এসে পৌছায়, তখন ভারতীয় কতৃপক্ষ এই তদন্তের ব্যাপারে অন্ধকারে ছিল। তবে শাস্ত্রীর পরিবার তার মৃতদেহ দেখে তাকে হত্যা করায় হয়েছে বলে সন্দেহ করতে থাকে। শাস্ত্রীর দেহের অনেক জায়গায় নীলচে ছোপ ছোপ দাগ ছিল। তার ঘাড়, তলপেটে কাটার দাগ ছিল। সেই কাটা দাগ থেকে রক্ত ঝরে তার পোশাকের অনেক জায়গা ভিজিয়ে দিয়েছিল। শাস্ত্রীর মা ছেলের লাশের সামনে চিৎকার করে বলতে থাকেন,” ওরা আমার ছেলেকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে।“ শাস্ত্রীর স্ত্রী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বলে গিয়েছেন, তার স্বামীকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।

সেসময় পত্রিকাগুলো এ নিয়ে অনেক সংবাদ প্রকাশ করে। তার নিজ দল কংগ্রেসের অনেক সাংসদ একই দাবি করে। কুলদীপ নায়ার জানান, একদিন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তাকে ফোন করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যূর ব্যাপারে যেস গুজব ছড়িয়েছে তিনি যেন এর বিরুদ্ধে কিছু বলেন। নায়ার এতে আপত্তি জানান। সেই সচিব তাকে পরে আরো অনেকবার বিষয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেন। ভারতীয় পার্লামেন্টারি অনুসন্ধানী দল তদন্ত করে এ ব্যাপারে কিছুই পায়নি। তবে সেই তদন্তের অনেক ফাইল ধ্বংস করে দেয়া হয়, যা আরো সন্দেহের উদ্রেক করে। সে সময় বলা হয় শাস্ত্রীর কোনো পোস্টমর্টেম করা হয়নি। যদি পোস্টমর্টেম না করা হয়, তবে তার গায়ে কাটা দাগ কেন? এর কোনও সদুত্ত্যর সেসময় কতৃপক্ষ দিতে পারেনি। তার চিকিৎসক ডাঃ চুঘ দাবী করেন, শাস্ত্রীর স্বাস্থ্যর অবস্থা বেশ ভালো ছিল। হার্ট এটাক করার মত কোনো কারণ ছিল না। ২০০৯ সালে ভারতীয় কতৃপক্ষ জানায়, সেইসময় ভারতীয় আর রাশিয়ান ডাক্তাররা তার লাশ পরিক্ষা করেছিলেন।

এর বাইরের অনেক ঘটনা, এই মৃত্যূ রহস্যকে আরো ঘনীভূত করে। যেমন, ১৯৭৭ সালে এই বিষয়ে সাংসদীয় কমিটির কাছে বক্তব্য রাখার আগে ডাঃ চুঘের গাড়িকে একটি ট্রাক চাপা দিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে তিনি, তার স্ত্রী, দুই পুত্র মারা যান। তার কন্যা এতে পঙ্গু হয়ে যান। শাস্ত্রীর গৃহপরিচারক রামণাথ বলেছিলেন, তিনি সাংসদীয় কমিটির কাছে সব বলে দিবেন। রামণাথ কমিটির কাছে যাবার আগেই গাড়ি চাপায় আহত হন। তার স্মৃতি হারিয়ে যায়। বাবুর্চি জান মুহাম্মদকে এই ঘটনার পর রাষ্ট্রপতির বাসভবনে নিয়োজিত করা হয়।
ভারত সরকার এ ব্যাপারে সবসময়ই একটা নিরবতা পালন করে। ভারতের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘আউটলুক ইন্ডিয়া’ লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যাতে প্রধানমত্রীর মৃত্যুকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র তত্ব বেরিয়ে আসে। এর বাইরে লেখক অনুজ ধর এ বিষয়ে কোনো গোপন দলিল থাকলে তা ‘রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টের’ আওতায় প্রকাশের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বরাবর আবেদন করেন। তার আবেদনের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর জানায়, এ বিষয়ে তাদের কাছে থাকা গোপন দলিল ‘রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্টের’ আওতামুক্ত। এসব দলিল প্রকাশিত হলে তা ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকেও একই জবাব দেয়া হয়। তবে তিনি দিল্লি পুলিশ বিভাগে একই বিষয়ে আবেদন করলে তারা জানায়, তাদের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দলিল নেই।

২০১৩ সালে মার্কিন সাংবাদিক গ্রেগরি ডগলাসের প্রকাশিত একটি বইতে , সাবেক মার্কিন গুপ্তচর রবার্ত ক্রাউলি জানান, তারা ভারতীয় পরমাণু বিজ্ঞানী হোমী ভোম্বাকে বিমান দুর্ঘটনার মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন। তিনি আরও জানান, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রিকেও তারা হত্যা করেছিলেন। এর প্রধান কারণ, শাস্ত্রী ভারতের পরমাণূ প্রকল্প নিয়ে খুব দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন। তিনি পরমাণূ পরিক্ষার সকল প্রস্তুতি নিতে আদেশ দিয়েছিলেন। এ অঞ্চলে সোভিয়েতদের প্রভাব বেড়ে যাবার ব্যাপারে মার্কিন সরকার বেশ উদ্বিগ্ন ছিল। এ সব কিছু মিলিয়ে শাস্ত্রীকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে ভারতজুড়ে অনেকেই দাবী করেন,ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশেই শাস্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছিল। এ দাবির বিপরীতে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার সম্প্রতি এ বিষয়ে বেশ কিছু গোপন নথি প্রকাশ করেছে।
তবে আজ অবধি এটি একটি রহস্যই রয়ে গেছে। কারণ, অফিশিয়ালি এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানানো হয়নি। ভারত সরকার তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট এটাকই মেনে নেয়। তবে পত্র-পত্রিকায় এখনো এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র তত্ব আলোচনা করা হয়। শাস্ত্রীর পরিবার এখনো বিশ্বাস করে, তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। দু’বছর আগেও এক সাক্ষাতকারে তার এক নাতী জানান, তাদের কাছে এখনও শাস্ত্রীর রক্তমাখা জামা আছে।