ল্যাভন অ্যাফেয়ারঃ ইজরায়েলের এক লজ্জাজনক অধ্যায়

১৯৫৪ সালের জুলাই মাস, কায়রোর রিও থিয়েটারের রাস্তা ধরে হেটে যাচ্ছে এক যুবক। তার পকেটে এসিড নাইট্রোগ্লিসারিন দিয়ে তৈরি একধনের বোমা আছে। যুবককে অনুসরণ করছে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। তার পাসপোর্টে নাম লেখা আছে, পল ফ্রাঙ্ক। জার্মান নাগরিক,যে কিনা একসময় নাৎসি বাহিনীর সদস্য ছিল। কিন্তু তার আসল নাম, এভারি এলাদ। ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা আমানের একজন এজেন্ট। মূলত সে , বোমাবাহী যুবকসহ আরো বেশ কয়েকজন ইজরায়েলি প্রবেশ করেছে মিশরে। তারা সবাই মোসাদ আর আমানের একটা সম্মিলিত দলের সদস্য নাম- ইউনিট-১৩১। তাদের দলনেতার নাম আব্রাহাম ডার। তাদের সবাই একটা মিশনে মিশরে মিলিত হয়েছে। যার কোড নেম, অপারেশন ‘সুসানাহ’। ইজরায়েলি প্রতিরুক্ষামন্ত্রী পাহনিস লাভন সরাসরি এই অপারেশন অনুমোদন করেছেন। অপারেশনের উদ্দেশ্য হল, মিশরে থাকা মার্কিন, ব্রিটিশ স্থাপনায় বোমা হামলা চালানো। এসব স্থাপনায় হামলা হলে তার জন্য মুসলিম ব্রাদারহুডকে দায়ি করতো ইজরায়েল। এই ফলসফ্ল্যাগ অপারেশনের আরো উদ্দেশ্য হল, মিশরে থাকা ইহুদিদের ইজরায়েলে আসতে বাধ্য করা। মিশর আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান উন্নতি ইজরায়েলের জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল।

তবে অপারেশন শুরুর আগ থেকে এ নিয়ে ইজরায়েলি দুই গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ আর আমানের মধ্যে টানাপোড়ন চলছিল। দুই সংস্থাই এই ইউনিটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দে লিপ্ত ছিল। ইজরায়েল এই অপারেশনের জন্য মিশরীয় ইহুদিদের এজেন্ট হিসাবে রিক্রুট করা শুরু করে। মিশরীয় ইহুদীরা ইজরায়েল রাষ্ট্রের শুরু বহু আগ থেকেই তাদের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তিতে নিয়োজিত ছিল। তারা জুলাই মাসের শুরতেই বেশ কয়েকটি জায়গায় বোমা হামলা চালিয়ে বসে। হামলার পরপরই মিশরীয় কতৃপক্ষ মাঠে নামে।

রিও থিয়েটারে হামলা চালাতে আসা যুবক জানতো না, তার ব্যাপারে এরই মধ্যে মিশরীয় গোয়েন্দারা আগাম তথ্য পেয়ে গেছে। সে বোমা বসানোর সাথে সাথেই তাকে পুলিশ ধরে ফেলে। তাকে অনুসরণ করতে আসা এলাদ ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। একের পর এক ইজরায়েলি চর ধরা পড়তে থাকে। দলনেতা আব্রাহাম আর এলাদ পালিয়ে গেলেও আরেক ইজরায়েলি নাগরিক মেইর ম্যাক্স বেনিথ ধরা পড়েন। মিশরীয় কতৃপক্ষ আটক হওয়া চরদের বিচার শুরু করে। মেইর আর আরেকজন এজেন্ট জেলে আত্মহত্যা করে।

ইজরায়েলি এজেন্টরা যখন একের পর এক ধরা পড়ছে, তখন ইজরায়েলি সরকার এই ঘটনায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে থাকে। শুরু হয় ইজরায়েলি কেবিনেটের মধ্যে কাদা ছুড়াছুঁড়ি । এই ঘটনার দায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী লাভন আরেক মন্ত্রী শীমন পেরেজের উপর চাপিয়ে দেন। কিন্তু মোসাদ প্রধান মোসে দায়ান পেরেজকে নির্দোষ দাবি করলে , প্রধানমন্ত্রী মোসে সারেত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে মিশরীয়দের কাছে এই ঘটনার আগাম তথ্য দেয় এজেন্ট এলাদ। সে মিশরীয়দের কাছে আরো তথ্য বিক্রি করার সময় ধরা পড়ে। মজার বিষয় এত কিছু ঘটছিল একেবারে গোপনে। ইজরায়েলি আর পশ্চিমা মিডিয়া ইজরায়েলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকার প্রমাণ থাকা সত্বেও তা এড়িয়ে যায়। ইজরায়লে এই ঘটনা পরিচিত হয় ‘ল্যাভন অ্যাফেয়ার’ নামে। ইজরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী লাবভনের ক্যারিয়ার সেখানেই শেষ হয়ে যায়। ইজরায়েল ঘটনার ৫১ বছর পর এই ঘটনায় জড়িত সব এজেন্টকে বিশেষ সম্মাননা দেয়।