কালাচি: কাজাখস্তানের রহস্যময় ঘুমন্ত গ্রাম

মানব জীবনের এক তৃতীয়াংশ কেটে যায় ঘুমে।এত ঘুমের পরেও ঘুম নিয়ে মানুষের মাথাব্যথার শেষ নেই।কম নাকি বেশি ঘুমাবেন আবার অনেকে ঠিক কতক্ষণ ঘুমাবেন তা নিয়ে চিন্তিত থাকেন। আবার বয়স ভেদে ঘুমের চাহিদা ভিন্ন।ঘুম শরীরকে চাঙ্গা রাখে পুনরায় কাজ করার শক্তি যোগায়। নিদ্রাহীনতার জন্য যেমন শারীরিক ক্ষতি হয় তেমনি অতিরিক্ত ঘুমও স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর। আসলে কতক্ষণ ঘুম স্বাস্থ্যর জন্য উত্তম? সাধারণত চিকিৎসকেরা ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমের পরার্মশ দিয়ে থাকেন।ঘুম না আসা অর্থাৎ ইনসমোনিয়া একটি মারাত্মক রোগ।যার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়।অন্য দিকে অতিরিক্ত ঘুম বা স্লীপ হলো ও আরেকটি মারাত্মক রোগ । এ রোগটি সর্ব প্রথম দেখা যায় ২০১৩ সালে কাজাকাস্তানের একটি গ্রামে। যেখানকার অনেক বাসিন্দা হঠাৎ টানা কয়েক দিন এমনকি সপ্তাহখানিক একটানা ঘুমাতে থাকে। আজ থাকছে রহস্যময় ঘুমের গ্রাম কালাচির অতিরিক্তঘুমের পেছনের রহস্য নিয়ে গল্প ।

শুদু মানুষই নয় পশুপাখি সহ একটা গোটা গ্রাম কখনও পথ চলতে চলতে ,কথা বলার সময় বা কাজ করতে করতে আচমকাই ঘুমিয়ে পড়ছে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হল তারা কেউ ক্লান্ত নয়। টানা কয়েক দিন ধরে চলতে থাকে এ ঘুম।আর এ ঘটনা নতুন নয় ঘটছে বেশ কয়েক বছর ধরে।জেগে ওঠার পর অনেকেই তাদের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। তারা ঘুমের আগে যা বলেছিলেন কিংবা করেছিলেন তার কিছুই মনে করতে পারে না। এ ঘুম এতই মারাত্মক কোন কোন ক্ষেত্রে রোগী হেলুসিনেশন ঘটে। বাস্তবে সত্য নয় এমন কিছু দেখতে পায় তারা।এছাড়াও বহুক্ষণ পর ঘুম ভাঙলে বেশ কয়েক দিন ধরে মাথা ব্যাথা ও বমি বমি ভাব হয়। আবার অনেকের রক্তচাপ বেড়ে যায় মাত্রাহীন ভাবে। ঘুমিয়ে পড়ার এই ঘটনা প্রথম নজরে ২০১৩ সালে।

গ্রামটির নাম কালাচি বা কালাচেভ। যেটি অবস্থিত রাশিয়ার সীমান্ত থেকে ১৫০ মাইল দক্ষিণে কাজাকাস্তানের আকমলিনস্ক জেলায়। আকমলা শব্দ থেকে আকমলিনস্ক নামটি এসেছে।কাজাখ ভাষায় যার অর্থ সাদা কবর। গ্রামটির মোট জনসংখ্যা ৮১০ জন। এর মধ্যে প্রথম পর্যয়ে এ সমস্যায় আক্রান্ত হন ১৪০ জন। ২০১০ সালে লিউভক বেলকোভ নামের এক নারী প্রথম এ রোগের শিকার হন। বাজারে কাজ করার সময় হঠাৎ তীব্র ঘুম পায় তার ।৪ দিন বাদে তিনি ঘুম থেকে ওঠেন । অব্যশ তখন চিকিৎসকেরা জানান তার স্ট্রোক হয়েছিল।পরবর্তীতে এ ভুল ভাঙ্গে যখন গ্রামের অনেকেই এ অদ্ভুদ ঘুমে আক্রান্ত হন । এরপর কালাচির এক প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস শুরুর কিছুক্ষণ পর দেখা যায় শিক্ষক সহ সব শিক্ষার্থী ঘুমাচ্ছে । প্রায় ৪ ঘণ্টা ঘুমানোর পর তাদের ঘুম ভাঙ্গে। ২০১৩সালে প্রায় ১২০ জন একত্রে আক্রান্ত হলে বিষয়টি বিশদ ভাবে সবার নজরে আসে। আর দ্রুত কালাচি “ঘুমপাড়ানি গ্রাম” হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কারো কারো ক্ষেত্রে এ ঘুম রোগ একাধিকবার ঘটেছে।যা তাদের প্রত্যহিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে ।

এই ঘুমের কারণ কি? কিভাবে মুক্তি পাবে সবাই? এ নিয়ে চিকিৎসকেরা কোন উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।বরং তারা একে গ্রামবাসীর মানসিক সমস্যা হিসেবে ধারণা করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক,রেডিওলজিস্ট , টক্সিকোলোজিস্ট , চিকিৎসক এবং ইরলোজিস্ট সবাই কালাচিতে আসেন এবং ঘুমের কারণ খুজতে থাকেন। পরীক্ষা করেন এখানকার মাটি ও পানি। আক্রান্ত গ্রামবাসীদের ব্রেন স্ক্যান করলে দেখা যায় তাদের মস্তিষ্কে অতিরিক্ত তরল পদার্থ আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে “ইডিমা” বলে।যদিও এই অতিরিক্ত ঘুমের কারণ তখনও থেকে যায় অজানা। তবে গ্রামবাসীদের সন্দেহ তাদের এই ঘুমের পেছনে ক্রাসনোগোরস্কি ইউরোনিয়াম খনির বাতাস দায়ী। যেটি কালাচির পাশের গ্রামে অবস্থিত।যদিও ১৯৯০ সালে সোভিয়েত যুগে ঐ খনি বন্ধ হয়ে যায়। খনির ভিতর ও বাহিরের বিকিরণ পরীক্ষা করে দেখা যায় রেডিয়েশনের পরিমাণ বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। এছাড়াও রেডিয়েশনের কারণে মানুষের ক্যানসার কিংবা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিকৃতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।যার কিছুই হয় নি। তবে রেডিয়েশনের কারণে দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়ে থাকা বা অতিরিক্ত ঘুমের কোন সম্পর্ক নেই। কালাচির মাটি ও পানি পরীক্ষা করে কোন বিষাক্ত উপাদান মেলে নি।তাই অনেকেই ধারণা করেন ভিনগ্রহের কোন উপদ্রবের ফলেই ঘুমিয়ে পড়েন গ্রামবাসী।

সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০১৫ সালে বিজ্ঞানীরা রেডিয়েশন নয় বাতাসে উপস্থিত কার্বন মনোক্সাইড এবং হাইড্রো কার্বনের অতিরিক্ত পরিমাণকে এই ঘুমের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কার্বন মনোক্সাইড অক্সিজেনের তুলনায় ২০০ গুন দ্রুত রক্তে মেশে । ফলে শরীরে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে মস্তিষ্কে অক্সিজেন পৌঁছাতে দেয় না । আর অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলাফল বহু ঘণ্টার জন্য মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। কালাচির বাতাসে উপস্থিত কার্বন মনোক্সাইডের উৎস হল ইউরোনিয়ামের খনি। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কীভাবে এই গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে তার কোন সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি । রাশিয়ান গবেষক লিওনাভ রিখভানভ বলেন “ইউরেনিয়াম খনিটি বন্ধ হলেও ভূগর্স্থ পানির সাথে রেডন ও অন্যান্য গ্যাস যা ইউরিনিয়ামের ক্ষয়ের ফলে উৎপন্ন হয় । তা মিশে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়। ”