
রাজা গণেশ ছিলেন বাংলার একজন প্রতাপশালী হিন্দু শাসক। তিনি পঞ্চদশ শতাব্দী তে বাংলা শাসন করেন। তিনি ইলিয়াস শাহী বংশের দুর্বল সুলতানের নিকট থেকে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বাংলার রাজা হন।
রাজা গনেশ এর জন্ম ও বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় নি। আইন-ই-আকবরী, তবাকত-ই-নাসিরী এবং তারিখ-ই-ফিরিশতা থেকে তার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়। তার প্রকৃত নাম ‘গনেশ নারায়ণ’। তাঁর পুত্র সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ এর মুদ্রায় তাঁর নাম ‘কানস রাউ’ বা ‘কানস শাহ’ বলে উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে ইন্দো-পারসীক ইতিহাসবিদরা তাঁকে ‘রাজা কংস’ বা ‘রাজা কানসি’ বলে উল্লেখ করেছেন।
রিয়াজ-উস-সালাতিন অনুসারে, রাজা গণেশ বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার ভাতুরিয়ায় জমিদার ছিলেন। অন্যদিকে ফ্রান্সিস বুচানন হ্যামিল্টন দাবি করেন, তিনি উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের হাকিম (গভর্নর) ছিলেন। আবার অনেকের মতে, তিনি রাজশাহী জেলার ভাতুরিয়া ও দিনাজপুরের জমিদার ছিলেন।
যদিও তিনি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁর আচরণ ছিল প্রতাপশালী ক্ষত্রিয়’র মত। তার অর্ধাঙ্গীনির নাম ছিলো, ‘ফুলজানি’।
গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালের শেষের দিকে ফিরুজাবাদের (পান্ডুয়া) ইলিয়াসশাহী রাজদরবারে যেসকল অমাত্য প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন, গণেশ তাঁদের অন্যতম।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ’র মৃত্যুর পর উপযুক্ত শাসকের অভাবে বাংলায় চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। সিংহাসন তখন শিহাবুদ্দীন বায়াজীদ শাহ’র দখলে। গোপন সূত্র থেকে রাজা গনেশ জানতে পারেন যে, ইনি সাইফুদ্দিনের দাসীপুত্র বা ক্রীতদাস ছিলেন। এছাড়াও চতুর রাজা গনেশ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বর্তমান সুলতান শিহাবউদ্দীন বায়েজীদ শাহ একজন দুর্বল, অত্যাচারী ও নির্বোধ শাসক। তাই তিনি ঠিক করলেন, শিহাবুদ্দিন কে হটিয়ে নিজে সিংহাসন দখল করবেন।
এরপর একদিন স্থানীয় অরণ্যে শিকারপর্ব চলার সময় গণেশ পশ্চাৎ থেকে শর নিক্ষেপ করে সুলতান শিহাবুদ্দীন বায়েজীদ শাহকে হত্যা করে। ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে, ইলিয়াস শাহী বংশীয় সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ সিংহাসনে বসলে গণেশ প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে মুখোমুখি যুদ্ধে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ কে হত্যা করে গৌড়ের সিংহাসনের দখল নেন।
গৌড়ের সার্বভৌম নৃপতি হয়েই, হিন্দুর ঘোষিত শত্রু হিসেবে স্বীকৃত মুসলিম নিধনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। দ্রুত মুসলিম আনুগত্যের পর্দা ছেড়ে বের হয়ে এসে মহারাজা গনেশ নারায়ণ তাঁর রাজ্যে সমস্ত সুফি সন্ন্যাসী আর দরবেশদের নিষিদ্ধ করে দেন। বাংলায় মুসলিম শাসন উৎখাতের জন্য মুসলমানদের নির্যাতন ও উচ্ছেদ করার নীতি গ্রহণ করেন।
বুকানন হ্যামিল্টন কর্তৃক লিখিত দিনাজপুর বিবরণীতে উল্লেখ আছে যে, জনৈক শেখ বদরে ইসলাম এবং তার ছেলে ফয়জে ইসলাম গণেশকে অবনত মস্তকে সালাম না করার কারণে তিনি উভয়কে হত্যা করেন। শুধু তাই নয়, বহু মুসলমান অলী দরবেশ, মনীষী, পন্ডিত ও শাস্ত্রবিদকে গণেশ নির্মমভাবে হত্যা করেন।
এছাড়াও প্রচলিত আছে যে, শেখ মুঈনুদ্দীন আব্বাসের পিতা, শেখ বদরুল ইসলাম, বিধর্মী রাজা গণেশকে সালাম না করার কারণে তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হন। অতঃপর একদিন তিনি উক্ত শেখকে দরবারে আসার জন্যে খবর পাঠান। তার কামরায় প্রবেশের দরজা এমন সংকীর্ণ ও খর্ব ছিল যে, প্রবেশকারীকে উপুড় হয়ে প্রবেশ করতে হয়। শেখ চিরাচরিত ইসলামী সাম্প্রদায়িক মনোভাব বশত ইচ্ছে করেই প্রথমে তাঁর দু’খানি পা কামরার ভিতরে রাখেন এবং মস্তক অবনত না করেই প্রবেশ করেন। কারণ, ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী কোন মুসলমানই আল্লাহ ব্যতীত আর কারো সামনে মস্তক অবনত করতে পারেন না। গণেশ এর কারন জিজ্ঞাসা করায় বদর উল ইসলাম বলেন “শিক্ষিত লোক বিধর্মী কে অভিবাদন করেন না”। এরপর ক্রুদ্ধ রাজা গণেশ উদ্যত তলোয়ার হয়ে তাঁকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করেন এবং অন্যান্য আলেমদের একটি নৌকায় বন্দি করে নদী-গর্ভে নিমজ্জিত করে মারেন।
মুসলিম নিধনের এ শিউরে উঠা কাহিনী শোনার পরে শেখ নূরে কুতুবে আলম মর্মাহত হন এবং জৌনপুরের গভর্ণর সুলতান ইব্রাহীম শার্কীকে বাংলায় আগমন করে, ইসলাম ধর্ম রক্ষার জন্যে আবেদন জানান। সুলতান ইব্রাহীম বিরাট বাহিনীসহ বাংলা অভিমুখে যাত্রা করে সরাই ফিরোজপুরে শিবির স্থাপন করেন।
ইব্রাহীম শার্কী’র বাংলা আগমনের বিষয়ে মুসলিম ও চিনা-আরাকান সূত্রের মধ্যে অনেক তফাত লক্ষ্য করা যায়।
ইসলামী ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইব্রাহিমের আসার খবর রাজা গণেশ জানতে পেরে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কুতুবে আলমের শরণাপন্ন হলে তিনি গণেশ কে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেন। গণেশ অস্বীকার করলে অবশেষে তাঁর পুত্র যদুকে ইসলামে দীক্ষিত করে গণেশের স্থলে তাকে সিংহাসন ছেড়ে দেয়ার জন্যে বলা হয়। গণেশ এ কথায় স্বীকৃত হন। যদুর মুসলমানী নাম জালাল উদ্দীন রেখে তাঁকে বাংলার সুলতান বলে ঘোষণা করা হয়। সুলতান ইব্রাহিম অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ মনে প্রত্যাবর্তণ করেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পাওয়া মাত্র গণেশ জালালউদ্দীনের নিকট থেকে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন।
চিনা ও আরাকান ইতিহাস অনুযায়ী, মহারাজ গনেশ অত্যন্ত বীরত্ব আর চতুরতার সাথে ইব্রাহিম সেনাদের মোকাবিলা করেন। এক ভয়ানক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পরাজিত হয়ে জৌনপুরের সেনাবাহিনী পালিয়ে যায়।
অবস্থা বেগতিক দেখে নূর কুতুব আলম গোপনে রাজা গনেশের জ্যৈষ্ঠ পুত্র যদু কে অপহরণ করেন বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত করেন।
লোক মারফৎ গনেশ কে জানানো হয়, তিনি যদি স্বেচ্ছায় রাজসিংহাসন ত্যাগ করে তাঁর ছেলে কে গৌড়ের নয়া শাসক ঘোষিত করেন তবেই মুক্তি দেওয়া হবে তাকে। তিনি তা মেনে নিলেন।
১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে, বিধর্মী পুত্র জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে পুনরায় নৃপতি হলেন গনেশ। ধারন করেন ‘দনুজমর্দনদেব’ উপাধি। এই নামেই চালু করলেন নতুন রৌপ্য মুদ্রা।
কিন্তু জালালউদ্দিন শৈশবে নুর কুতব আলমের নিকট ধর্মান্তরিত হওয়ায় তার মধ্যে ইসলামের প্রতি নিষ্ঠা প্রকট হয়ে ওঠে এবং তিনি ইসলাম ত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। এই ঘটনায় রাগান্বিত হয়ে গনেশ তার ছেলে কে বন্দী করেন।
১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে, জালালউদ্দিন বন্দী অবস্থায় থেকে ভৃত্য দের সাথে ষড়যন্ত্র করে তার পিতা রাজা গণেশ কে হত্যা করেন।
রাজা গণেশ তাঁর স্বল্পকালীন শাসনে প্রায় সমগ্র বাংলার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিত্বের অধিকারী রাজা গণেশ ছিলেন একজন চতুর কূটনীতিক। অনেকের মতে, তিনি দেবী চন্ডীর ভক্ত ছিলেন। জানা যায়, শিল্প সাহিত্যের প্রতি বেশ অনুরাগী ছিলেন তিনি। গৌর- পাণ্ডুয়ার বেশকিছু স্থাপত্য শিল্প তিনি তৈরি করেছিলেন।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাহ! রাজা গণেশ সম্পর্কে জেনে উপকৃত হলাম৷ ধন্যবাদ
রাজা গণেশ সম্পর্কে জেনে উপকৃত হলাম!