বাঙালি কেন বিশ্বমোড়ল নয়?

আচ্ছা, কখনো কি ভেবে দেখেছেন মার্কিনিরা কেন বিশ্ব মোড়ল হিসেবে পরিচিতি পায় আর বাঙালি কেন তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে খ্যাতি পায়!
আজকে আপনাদের একটি ঘটনা শুনাই, সদ্য পনের বছর বয়স পেরোন এক বালকের ঘটনা৷
আমেরিকান সে বালকটি কোন এক দোকান হতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় । শুধু কি তাই! প্রহরীর হাত থেকে পালানোর সময় দোকানের একটি শেলফও ভেঙে ফেলে বালকটি । অবস্থা গম্ভীর! দোকানের মালিক রেগেমেগে পুলিশের হাতে হস্থান্তর করে বালকটিকে।
বালকটিকে কোর্টরুমে বিচারকক্ষে নিয়ে আসা হলে বিচারক বালকটিকে জিজ্ঞেস করেন ;
সে কি সত্যিই কিছু চুরি করেছে? রুটি কিংবা চিজের কোন প্যাকেট?
লজ্জিত সে বালকটি মাথা নিচু করে উত্তর দেয় ;হ্যাঁ!সে চুরি করেছে।
বিচারক জিজ্ঞেস করে কেন সে এমন কাজ করল?
বালক জবাবে বলে -তার প্রয়োজন ছিল তাই।
বিচারক এবার বলেন- কিনে নিলেই হত।
বালকটি এবার প্রতুত্তরে জানায়; তার কাছে কোন টাকা ছিল না।
বিচারক এবার বলেন- তাতে কি হয়েছে; পরিবার থেকে নিতে পারতে!
দুঃক্ষিত হৃদয়ে বালকটি এবার জবাব দেয়; তার বাড়িতে নাকি শুধু তার মা’ই রয়েছে। মা অসুস্থ, তার জন্যই রুটি চুরি করতে হয়েছিল বালকটিকে।
বিচারক যখন জিজ্ঞেস করে সে কোন কাজ করে কিনা!
বালকটি এরপর নিজের ভেতর চেপে রাখা ক্ষোভ নিয়েই বলতে শুরু করে – গাড়ি ধোওয়ার কাজ করত সে, মা অসুস্থ হওয়ায় একদিনের জন্য ছুটি নেয়াতেই কাজ চলে গিয়েছিল তার।
বিচারক এবার জানতে চাইলেন- “কারো কাছে কি সাহায্য চাও নি?
বালকটি জানাল- সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় পঞ্চাশজন মানুষের কাছে সাহায্য চাইলেও প্রত্যেকেই তাকে ফিরিয়ে দেয় খালি হাতে। শেষে আর কোন পথ না পেয়ে তাকে এ পথটি বেছে নিতে হয়েছে।
বিচারক বালকটির সাথে কথা-বার্তা শেষে এবার অত্যন্ত লজ্জাবোধ করলেন।লজ্জিত কন্ঠে বলতে শুরু করলেন;
” চুরি, বিশেষ করে রুটি চুরি একটি অত্যন্ত লজ্জাজনক অপরাধ। আর এই অপরাধের জন্য আমরা সবাই দায়ী। এই আদালতে উপস্থিত প্রত্যেকে, আপনাদের মধ্যে আমিও আছি, এই অপরাধের সাথে যুক্ত। তাই এখানে উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তিকে দশ ডলার করে জরিমানা করা হলো। দশ ডলার এখানে জমা না দিয়ে কেউ এখান থেকে যেতে পারবে না।”
এই বলে দুক্ষঃভারাক্রান্ত বিচারক নিজ পকেট হতে ১০ ডলার বের করে টেবিলে রেখে আবার কলম নিয়ে রায় লিখতে শুরু করলেন। লিখলেন,
“এ ছাড়াও যে দোকান ক্ষুধার্ত ছেলেটিকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে সেই দোকানকেও আমি এক হাজার ডলার জরিমানা দিতে আদেশ করছি। জরিমানার টাকা যদি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জমা দেওয়া না হয়, আদালত দোকানটিকে সিল করে দিতে নির্দেশ দেবে। জরিমানার সমস্ত টাকা এই ছেলেটির হাতে তুলে দিয়ে আদালত তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।”
বিচারকের রায় শোনার পর প্রত্যেকের চোখে পানি এসে গিয়েছিল । প্রত্যেকে নিজ পকেট হতে সতঃস্ফূর্ত ভাবে জরিমানাকৃত টাকা বের করে দিয়েছিল৷ হতবাক সে কিশোর বালকটিও সারাজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে গিয়েছিল তার রাষ্ট্রের প্রতি।
এবার আপনাদের আরেকটি ঘটনা শুনাই;
আপনার আমার প্রাণের দেশ বাংলাদেশের একটি ঘটনা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ২১’শে ফেব্রুয়ারীর গভীর রাতে বিএনসিসি ক্যাডেট হিসেবে ডিউটিরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলছেন;
আমি সেদিন ডিউটিরত অবস্থায় অনেক মানুষকে দেখেছি। আমি দেখেছি ছেড়া কাপড়, উস্কোখুস্কো চুলে ঢাকা ৫/৬ বছরের বেশ ক’জন বাচ্চাকে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকতে । তার ঠিক অন্যদিকেই আমি আরো দেখেছি লাখ টাকার গাড়ি, হাই ব্রাইডাল মেক আপ, ক্লিন শেইভড, চোখে চশমা, গায়ে খাদি পাঞ্জাবি পড়া মানুষগুলো কোটি টাকার ফুল শ্রদ্ধার ভারে নুয়ে পড়ে জলাঞ্জলি দিতে পারলেও কোন এক অদৃশ্য বাধার কারণেই হয়ত হাত পেতে থাকা সে বাচ্চাগুলোকে ঠিক দেখে উঠতে পারছিল না।
ভাষা শহীদ রা হয়ত বা তখন এ জাতির অদ্ভূত কর্মকান্ড দেখে নিভৃতে কষ্টের হাসি হাসছিল আর ভাবছিল যে জাতি নিজ ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের দায়িত্ব নিতে পারে না তারা এসেছে আমাদের শ্রদ্ধা জানাতে!
মার্কিনি রা বিশ্বমোড়ল বোধহয় এ কারণেই, তারা জানে কিভাবে তাদের বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে হবে, কিন্তু আমরা বাঙালিরা ৯০% মুসলিমের দেশ হয়েও আমরা আমাদের বাচ্চাদের, প্রতিবেশীদের, গরীবদের দেখভাল করতে পারি না। আমরা আজো ফুটপাতের উপর,ওভার ব্রিজের উপর আমাদের অনেক নারীদের,বাচ্চাদের শীতের রাতে কাঁপতে ছেড়ে দিতে পারি কিন্তু তাদের দায়িত্ব আমরা আজো ঠিক নিয়ে উঠতে পারি না।
মার্কিনি রা তাদের কাজের মাধ্যমেই উত্তর দিয়ে দিচ্ছে একারণেই তারা বিশ্বমোড়ল তারা জানে তাদের অর্থ কোথায় ব্যয় করতে হবে কিন্তু আমরা আজো এটা বুঝে উঠতে পারি নি আমাদের সম্পদ ঠিক কোথায় ব্যয় করতে হবে। আমরা বুঝে উঠতে পারি নি শহীদরা বাচ্চাদের হাশিমুখ দেখলে খুশি হবে নাকি কোটি টাকার ফুল যা পরদিন পঁচে যাবে তা পরম শ্রদ্ধায় নিবেদন করলে খুশি হবে।
চাণক্যের মতে, রুটি চুরি করতে গিয়ে কোন ব্যাক্তি যদি ধরা পড়ে, তবে তা সে জাতির জন্য লজ্জাজনক। আমাদের দেশে হরহামেশাই নানা বালককে চুরি করতে দেখা যায়, করবে নাই বা কেন আমরা যে তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার সামর্থ্যটুকু পর্যন্ত রাখি না। কিন্তু আমরা দামী দামী রেস্টুরেন্টে যেয়ে দেদারছে গিলতে কিন্তু ঠিকই পারি।
আমরা বুঝে উঠতে পারি নি,আমরা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি।
মুহিব্বুল্লাহ খাঁন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরো পড়ুন;
পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না ;একটি বার্মিজ উপাখ্যান; https://cutt.ly/ezuVdaF