
বাঙালি অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েট যেখানে পড়ালেখা শেষে ব্যাংকের সেই গৎবাধা চাকুরি অথবা বিসিএস ক্যাডার নামক সরকারী আমলা হওয়ার স্বপ্নে অবতীর্ণ হয় সেখানেই বাংলার কিছু দামাল ছেলেকে দেখা যায় অদৃশ্য বাধন গুলো ছিড়ে নাম না জানা অজানা কোন গন্তব্যের দিকে পা বাড়াতে শুরু করে । আজ আপনাদের সেরকমই এক অকুতোভয় যুবকের গল্প শোনাতে যাচ্ছি।
অদৃশ্যের পথে পা বাড়ানোর অজানা গল্পটির সূচনা ২০১০ সনে শুরু হয়। যখন হাবিবুর রহমান জুয়েল নামক টগবগে এ যুবকটি সদ্য দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” এর ইতিহাস বিভাগ হতে মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষাজীবনে ইতি টানেন ।
পড়ালেখা শেষ করেই জুয়েল পুরান ঢাকার অলিগতেলিতে ঘুরে আবিস্কার করেন,
ফেলে দেয়া নিত্য ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বোতল গুলোকে গুড়ো করে বিদেশে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। ঘটনাক্রমে পরিচয় ও কথা হয় ব্যবসাটির সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত একজন মধ্যস্ততাকারীর সঙ্গে । আলাপ-আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণের পর জুয়েল দেশীয় কিছু হাতে তৈরি যন্ত্র, স্বদেশী কিছু কর্মী এবং বাবার কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা নিয়ে নেমে পড়লেন অজানা এক গন্তব্যের দিকে।
প্লাস্টিকের এসকল গুড়োকে ফ্লেক্স বলা হয়ে থাকে যা দিয়ে সিনথেটিক কাপড়, গৃহ নির্মাণসামগ্রী ও স্ট্রাপ উৎপাদিত হয়ে থাকে।
জুয়েল তার ব্যবসার প্রাথমিক কালের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানান ;
“ভাঙারিদের সঙ্গে ব্যবসা করতে হলে একদম তাঁদের সামনে যেতে হয়। আমি সে সময় শহরজুড়ে ভাঙারিদের খুঁজে বের করতাম, সেগুলা ভাঙানোর কাজ করতাম, রপ্তানির জন্য কাগজপত্র গোছানোর কাজ করতাম। সব মিলিয়ে দিনের ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কখন চলে যেত বুঝতেও পারতাম না।”
পরিশ্রমি এ যুবকের দিন-রাত কাজের ফলে খুব দ্রুতই এ ফিল্ডে হাত পাকতে থাকে তার। এমনকি ২০১৬ সালের মাঝেই দেশের অন্যতম প্লেট ফ্লেক্স রপ্তানী কারকদের মাঝে একজন হয়ে উঠেন জুয়েল।
ব্যবসাটিতে এত কম সময়ের মাঝে এতটা সিদ্ধহস্ত হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে জুয়েল বেশ কিছু কারণকে সামনে নিয়ে আসেন । তিনি জানান, ব্যবসাটি খুবই সনাতন পদ্ধতিতে হত , শিক্ষিত মানুষ এ ফিল্ডে ছিলো না বললেই চলে, মধ্যস্ততাকারী কিছু থাকলেও তারা নানা ভাবে গ্রাহক ঠকাতেন এক্ষেত্রে জুয়েল নিজে গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং চাহিদামাফিক পণ্য যথাসময়ে এনে দিতে পারার কারণে খুব কম সময়েই ব্যবসাটিতে ভালো করতে থাকেন।
সবকিছু ঠিকঠাক চললেও করোনা কালীন সময়ে অন্য সব ব্যবসার মত এ ব্যবসাতেও ধবস নামতে শুরু করে। চীন বাহির থেকে ফ্লেক্স উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এত বড় বড় কাস্টমার হারানোতে প্রায় মাঠে মারা যাওয়ার অবস্থায় হয় জুয়েলের মত এ ফিল্ডের ব্যবসায়ীদের।
তখনই অভাবনীয় কিছু ঘটনা ঘটে, চীনের যে প্রতিষ্ঠানটিতে এ যাবৎকাল জুয়েল ফ্লেক্স সাপ্লাই দিতেন সে কোম্পানিরই কিছু কর্মী তাকে দেশেই স্ট্র্যাপ তৈরির ব্যবসা শুরু করা যায় কিনা এ মর্মে পরামর্শ দেন। জুয়েল ভেবে দেখেন তিনি এ ফিল্ড টার সাথেই পরিচিত, লম্বা সময় এ ব্যবসাটাই করেছেন। তাই তিনি বাংলাদেশেই ফ্লেক্স উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেন। চীনা সেই বন্ধুর পরামর্শে দেশে নিয়ে আসেন বিদেশী কিছু মেশিন, চীনা দু’জন টেকনিশিয়ান। ঢাকার সোনারগাঁওয়ে দু’বিঘা জমির উপর গড়ে তোলেন মুনলাইট ফ্লেক্স অ্যান্ড স্ট্রাপ ইন্ডাস্ট্রি যেখানে তিনি ধীরে ধীরে স্ট্রেপের ব্যবসাতেও সিদ্ধহস্ত হতে চলছেন। এছাড়াও এখনো আদি পেশা ফ্লেক্স রপ্তানি হতেও সরে যাননি তিনি। এখনো ভিয়েতনাম, ভারতের মত দেশগুলোতে ফ্লেক্স রপ্তানি করে যাচ্ছেন জুয়েল।
বৎসরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব এ ফিল্ডটিতে তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জুয়েল জানান ;
“এই করোনায় অনেকেই ঝরে পড়বেন, যাঁরা টিকে যাবেন তাঁরা সামনে বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করবেন। আমি সেই আশাতেই কাজ করে যাচ্ছি।”
জুয়েল নিজ কষ্ট,পরিশ্রম, অজানাকে ভয় না পেয়ে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছেন। রাষ্ট্র বেচে থাকে এমন কিছু উদ্যমী যুবক দ্বারাই যারা নিজেদের ভাগ্যকে অদৃশ্যের হাতে ছুড়ে দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার সাহস রেখে থাকেন। জুয়েল জানেন না কাল কি হবে, বাস্তবতা সুখকর কিংবা কঠিন দুইই হতে পারে। কিন্তু যবে থেকে বাঙালি যুবকরা জুয়েলের মত সাহস দেখাতে শুরু করবে, বাঙালির ভাগ্যের শিকেও আমলা নামক গোলকধাঁধা হতে ছিড়তে শুরু করবে।
মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ খাঁন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরো পড়ুন;
পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না একটি বার্মিজ উপাখ্যান;https://cutt.ly/ezuVdaF