মাইকেল হলার্ডঃ যার জন্য রক্ষা পেয়েছিল লন্ডন

১৯৪৩ সালের অক্টোবরের এক দিন। ৪৫ বছর বয়স্ক ফরাসি নাগরিক মাইকেল হোলার্ড সীমান্ত পার হয়ে সুইজারল্যান্ডের ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার পিঠে দুই ব্যাগ ভর্তি আলু এর একখানা কুঠার। দেখে মনে হবে একজন সাধারণ কাঠুরে। তিনি দ্রুত এগুচ্ছিলেন বটে, তবে বিড়ালের মত নিঃশব্দে। একটু শব্দ হওয়া মানে টহলদার জার্মানবাহিনী অথবা ডগ স্কোয়াডের কানে যাওয়া। যার ফলাফল অনিবার্য মৃত্যু।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনার হোলার্ড মিত্রবাহিনীর পক্ষে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। মোট ৪৯ বার তিনি সুইজারল্যান্ডে সীমান্ত পার করে জার্মান বাহিনীর বিভিন্ন ঘাটী, কামান শ্রেণি, কোলনে অবস্থিত সাবমেরিন ঘাটি ও পুরো জার্মান ডিভিশনের গতিবিধি ও নির্ভুল অবস্থান সম্পর্কে অতি মূল্যবান অনেক তথ্য মিত্রবাহিনীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন তিনি যে তথ্য বহন করছিলেন তা পুর্বের যে কোনো তথ্যর থেকে স্পর্শকাতর ছিল। তার আলুর বস্তায় লুকিয়ে থাকা এক টুকরো কাগজ গোটা লন্ডন শহরকে ধ্বংসস্তুপ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল। হিটলারের গোপন ভি-১ রকেটের সবগুলো ঘাটির নকশা তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন।। প্রতি মাসে ৫ হাজার করে প্রায় ৫০,০০০ ভি-১ রকেট লন্ডনে নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন হিটলার। এগুলোর উৎক্ষেপণ করার উদ্দেশ্য যে বিশেষ প্লাটফর্ম তৈরি করা হ্যেছিল, তার অবস্থান সম্পর্কে চূড়ান্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছিল। এগুলো তৈরির কাজে ডাচ ও পোল যুদ্ধবন্দীদের নিয়োজিত করা হয়েছিল( যারা ফরাসী ভাষা বলতে বা বুঝতে পারতো না)।

মাইকেল হোলার্ডই একমাত্র মিত্রপক্ষীয় গুপ্তচর যে এই ঘাটিগুলোর সঠিক অবস্থান বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে মুহুর্তে তিনি ফরাসী সীমান্তের কাছে পৌছালেন ঠিক তখনই জার্মান ডগ স্কোয়াডের নজরে পড়ে গেলেন। সাথে কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু তাকে পার পেতেই হবে। কপাল ভালো তার। পায়ের কাছে পড়ে ছিল লাঠির মত শক্ত ও মোটা এক টুকরো কাঠ।চোখের নিমিষেই কুকুরটির ঘাড় হাটু দিয়ে চেপে ধরে, লাঠিটি কুকুরটির দুই চোয়ালের মাঝে চেপে ধরলেন। ধীরে ধীরে নিঃশব্দে এলিয়ে পড়লো কুকুরটি। কুকুরের আচড়ে ক্ষতবিক্ষত হাত-পা নিয়ে কাটাতারের ওপারে লাফিয়ে পড়তেই দেখলেন দুই সীমান্তরক্ষী সুইস সেনা বন্দুক তাক করে রেখেছে। কিন্তু না, হোলার্ডের দিকে নয় বরং হোলার্ডকে লক্ষ্য করে রাইফেল তাক করে থাকা জার্মান সেনার দিকে। চোখের পলকে জার্মান সৈনিকটি রাইফেল নামিয়ে নিল আর গজ গজ করে হেটে চলে গেল।

এ ঘটনার কয়েকদিনের মাথায় মিত্রবাহিনির বোমারু বিমানের আঘাতে ৭৩টি প্ল্যাটফর্ম সম্পূর্নভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। যদিও হিটলার তড়িঘড়ি করে মেরামত করে ছোট আকারের কিছু প্ল্যাটফর্ম থেকে বোমা মেরেছিলেন। কিন্তু তার ৫০,০০০ রকেট মারার স্বপ্ন কখনো পূরন হয়নি।
যুদ্ধের আগে মাইকেল হোলার্ড একটি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনে ডিজাইনারের চাকরি করতেন। জার্মানরা ফ্রান্স দখল করে নিলে তার মালিক জার্মানদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে। কিছুদিন পরই হোলার্ড একটি খোঁড়া অজুহাতে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তিনি মিত্রপক্ষের জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নন। খুব দ্রুতই দেশপ্রেমিক একদল রেল-শ্রমিক, লরি ড্রাইভার, মদের দোকানি ও ক্যাফে মালিকদের নিয়ে একটি সংগঠ ন গড়ে তোলেন। জার্মানরা আত্মসমপর্নের আগ পর্যন্ত তার দলের অন্তত ২০ জন সদস্য জার্মানদের হাতে প্রান হারান। সে যা হোক, হোলার্ডের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল ভি-১ রকেটের নকশা ফাঁস করা। ১৯৪৩ সালে রো শহরে দু’জন কনট্রাক্টরের মধ্যে আলাপ চলাকালে তিনি শুনতে পান জার্মানরা এক ধরনের ঢালু প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে অসাধারণ মজবুত করে। পরদিনই পাদ্রীর ছদ্মবেশে চাকুরি বিনিয়োগ কেন্দ্রে হাজির হন। কিছু বাইবেল দেখিয়ে বললেন, তিনি শ্রমিকদের মধ্যে এগুলো বিলি করতে চান। তাকে অফে নামক স্থানে যেতে বলা হয়। সেখানে বহু খোজাখুজি করে এক বনে কিছু রাজমিস্ত্রীকে দেখতে পান। তাদের কেউই ফরাসী ভাষা জানে না। তিনি সেখানে বিশেষ ধরনের ঢালু ৫০ গজ লম্বা প্ল্যাটফর্ম দেখতে পান। সবার অলক্ষ্যে তিনি পকেট থেকে ক্ষুদ্রাকৃতির একটি কম্পাস বের করে লক্ষ্য করেন, প্ল্যাটফর্মের উচু প্রান্তটি লন্ডনের দিকে তাক করা আছে। কালবিলম্ব না করেই তিনি তার ৪ সহকর্মীকে নিয়ে উত্তর ফ্রান্সে বেরিয়ে পরেন। ৮-৪ সপ্তাহের মধ্যে তারা এরকম ১০০টি প্ল্যাটফর্ম দ্রুত নির্মিত হতে দেখেন। তারা জানতে পারেন সবক্ষেত্রেই শ্রমিকরা তিন শিফটে ভাগ হয়ে ২৪ ঘন্তা এগুলো নির্মাণ করছে। হোলার্ড আর তার সহকর্মীরা একটি মানচিত্র তৈরি করে ভি-১ রকেটগুলোর অবস্থান ব্রিটিশ কতৃপক্ষকে জানিয়ে দেন। হোলার্ডের কাধে থাকা সেই আলুর বস্তার মধ্যে সেই ম্যাপটি লুকিয়ে রেখেছিলেন।

যুদ্ধের একেবারে শেষদিকে এক সহকর্মীর বোকামীর ফলে তিনি জার্মান্দের হাতে ধরা পড়েন। জার্মানরা তার উপর অ্কথ্য নির্যাতন চালিয়েও কোনো তথ্য আদায় করতে পারেনি। যুদ্ধবন্দি থাকা অবস্থায় একদিন জার্মানরা তাকেসহ অনেক যুদ্ধবন্দীকে উত্তর সাগরে ভাসিয়ে দেয়। এ সময় একটি সুইডিশ রেডক্রস জাহাজ কিছু বন্দীসহ হোলার্ডকে উদ্ধার করে। ছ’সপ্তাহ হাসপাতালে কাটিয়ে তিনি দেশে ফেরেন। ব্রিটিশ সরকার তার কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ তাকে ‘ ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস মেডেল’ প্রদান করে। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক ছিলেন। তার স্ত্রী-পুত্ররা অবশ্য তার গুপ্তচরবৃত্তির কথা কখনোই বুঝতে পারেনি।