ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বরিশাল জেলা

বরিশাল জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এ জেলাকে সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চল নামে অভিহিত করা হয়।
বরিশাল জেলার উত্তরে চাঁদপুর, মাদারিপুর ও শরিয়তপুর জেলা; দক্ষিণে ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা; পূর্বে লক্ষ্মীপুর, ভোলা জেলা ও মেঘনা নদী এবং পশ্চিমে পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জ জেলা অবস্থিত। বরিশাল জেলা শহরটি প্রাচ্যের ভেনিস নামে পরিচিত। এই জেলার মোট আয়তন ২,৭৮৪.৫২ বর্গকিলোমিটার।
চিত্রঃ বাংলাদেশের মানচিত্রে বরিশাল জেলা
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এই জেলার মোট জনসংখ্যা ২৩,২৪,৩১০ জন।
প্রশাসনিক পটভূমি
চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চল টি ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামে পরিচিত ছিলো। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তার কালে রাজা দনুজমর্দন কর্তৃক ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামে এ স্বাধীন রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
‘চন্দ্রদ্বীপ’ রাজ্য প্রতিষ্ঠার ও পূর্বে এ অঞ্চল ‘বাকলা’ নামে পরিচিত ছিল। যদিও খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকের আগে ‘বাকলা’ বা ‘চন্দ্রদ্বীপ’ এর রাজনৈতিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে অতি প্রাচীন বৈদেশিক মানচিত্রে ‘বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ’ নাম বড় অক্ষরে অঙ্কিত দেখা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে এই অঞ্চল মৌর্য ও গুপ্ত শাসনাধীন ছিলো।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে, বারভূঁইয়ার অন্যতম রাজা ‘কন্দপনারায়ণ’ চন্দ্রদ্বীপের রাজত্ব গ্রহণ করেন।
আঠার শতকের প্রথম দিকে, বরিশালের ইতিহাসের কিংবদন্তি আগা বাকেরের আবির্ভাব ঘটে। নবাব আলিবর্দি খাঁ যখন বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে বসেন (১৭৪০-১৭৫৬) তখন আগা বাকের সেলিমাবাদ পরগণার সাড়ে এগার আনি এবং বুজর্গ উমেদপুর সম্পূর্ণ অধিকার করেন। তার নামানুসারেই তখন এই জেলার নাম হয়েছিলো বাকেরগঞ্জ।
‘ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, বাকেরগঞ্জ’ থেকে জানা যায়, ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে, সিভিল জজ ও সুন্দরবন কমিশনারের দপ্তর নলছিটির বাড়ৈইকরণ থেকে বাকেরগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়।
১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে, বাকেরগঞ্জকে দপ্তর করে জেলা গঠিত হয়। ১৮০১ সালের ২৯ এপ্রিল, ঢাকা কোর্ট অব সার্কিট বরিশালে জেলা সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠার জন্য গর্ভনর জেনারেলের নিকট সুপারিশ করলে গর্ভনর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি সেটি অনুমোদন করেন। ফলে ওই বছরের ১লা মে, নিজামত আদালত জেলা সদর দপ্তর বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশালে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। তৎকালীন জেলা মেজিস্ট্রেট ও জজ মি. উইল্টন নিজামত আদালতের নির্দেশ অনুসারে জেলা সদর দপ্তর বরিশালে স্থানান্তর করেন। সেই থেকে বাকেরগঞ্জ জেলা সদর বরিশালে স্থাপিত হয়। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে, বাকেরগঞ্জ সীমানায় মাদারিপুর, কোটালীপাড়া জেলা ফরিদপুরভুক্ত হয়।
বরিশালের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে তদানীন্তন বৃটিশ সরকার ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্টে ফরিদপুর ও খুলনা জেলাসহ বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
পাকিস্তান আমলে বরিশাল জেলায় মোট ৬ টি মহকুমা ছিল। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে, পটুয়াখালী ও বরগুনা মহকুমার সমন্বয়ে পটুয়াখালীতে একটি জেলা গঠন করা হয়। পরবর্তীতে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে ১৯৮৪ সালে বরগুনা একটি নতুন জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এছাড়া, তৎকালীন বরিশাল জেলার ৩ টি মহকুমা ঝালকাঠী, পিরোজপুর ও ভোলা কে ও জেলায় উন্নীত করা হয়।
অবশেষে ফরিদপুর ও খুলনা জেলা বাদ দিয়ে ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি, প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য, বৃহত্তর বাকেরগঞ্জ জেলা নিয়ে বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে, বরিশাল পৌরসভা গঠিত হয় এবং পরবর্তীতে ২০০০ সালে, এটি কে সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তর করা হয়।
বরিশাল জেলা ৩০ ওয়ার্ডবিশিষ্ট ১ টি সিটি কর্পোরেশন, ১০ টি উপজেলা, ১৪ টি থানা, ৬ টি পৌরসভা, ৮৭ টি ইউনিয়ন, ১,১১৬ টি গ্রাম, ১০০১ টি মৌজা ও ৬ টি সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত।
নামকরণের ইতিহাস
বরিশাল নামকরণের পিছনে বিভিন্ন ধরনের মতভেদ রয়েছে।
অনেকের মতে, বড় বড় শালগাছ (বড়+শাল= বরিশাল) থাকার কারণে এই জেলার নামকরণ হয়েছে বরিশাল।
আবার অনেকেই মনে করেন, পর্তুগিজ বেরী ও শেলীর প্রেম কাহিনী থেকে এই জেলার নাম হয়েছে বরিশাল। যদিও এটি সম্পূর্ণ আন্দাজের উপর নির্ভর করে বলা হয়েছে।
বাংলার শস্য ভান্ডার বরিশাল একদা ‘এগ্রিকালচারাল ম্যানচেস্টার’ হিসেবে পরিচিত ছিল কেউ কেউ বলেন, বড় বড় লবণের গোলার জন্য এই জেলার নামকরণ করা হয়েছে বরিশাল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের চৌকি ছিল। এ জেলার লবণের বড় বড় চৌকি ও লবণের বড় বড় দানার জন্য ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা এ অঞ্চলকে ‘বরিসল্ট’ বলত। এ বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে বলে অনেকের ধারনা।
দর্শনীয় স্থান
বরিশাল বিভাগের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলোঃ- কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত; শাপলা বিল; জীবনানন্দ দাশ এর বাড়ি ‘ধানসিঁড়ি’; বঙ্গবন্ধু উদ্যান; শ্বেতপদ্ম পুকুর; বাউফলের কমলারাণীর দিঘী; বরিশালে মাধবপাশার দুর্গাসাগর দিঘী; মাধবপাশা জমিদার বাড়ি; শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক জাদুঘর; গুঠিয়া বায়তুল আমান মসজিদ; সোনার চর; মনসা মন্দির; সোনাকাটা এবং লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি ইত্যাদি।
চিত্রঃ বঙ্গবন্ধু উদ্যান
চিত্রঃ লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি
নদনদী
বরিশাল দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদীবন্দর। এই জেলা নিয়ে একটি অতি পরিচিত প্রবাদ আছে। তা হলো, “ধান-নদী-খাল এ নিয়ে বরিশাল”। বরিশাল জেলায় জালের মতাে নদী ছড়িয়ে আছে। এ জেলার প্রধান নদী গুলো হচ্ছেঃ- মেঘনা, তেঁতুলিয়া, ইলিশা, আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, হিজলা, বাকেরগঞ্জ, কালিজিরা এবং সন্ধ্যা।
কৃতী ব্যক্তিত্ব
বাঙালির অনেক কীর্তি আর কৃতিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে বরিশালের নাম। মহান নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক; কবি সুফিয়া কামাল; কবি জীবনানন্দ দাশ; কবি কামিনী রায়; বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর; কৌতুক অভিনেতা হানিফ সংকেত; কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ; চারণকবি মুকুন্দ দাস; কবি কুসুমকুমারী দাশ; দার্শনিক এবং লেখক আরজ আলী মাতুব্বর; সুরকার আলতাফ মাহমুদ; আগা বাকের খান; সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলিল সহ আরো অনেক কীর্তিমান জন্ম নিয়েছেন বরিশালে।
তথ্যসূত্রঃ
১. বাংলাপিডিয়া
২. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন
৩. বরিশাল ট্রিবিউন
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ধান নদী খাল এ ৩এ বরিশাল, সুন্দর লিখছিস।