কুমিল্লা জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

কুমিল্লা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এই জেলার কিছু অংশ গঠিত হয়েছে প্লাবন ভূমি দ্বারা এবং কিছু অংশ পাহাড়ি বৈশিষ্ট্যময়। বাকি অংশ সমতলভূমি।
কুমিল্লা জেলার মোট আয়তন ৩,০৮৫.১৭ বর্গ কি.মি.। এ জেলার দক্ষিণে ফেনী জেলা ও নোয়াখালী জেলা; পশ্চিমে চাঁদপুর জেলা, মেঘনা নদী ও মুন্সিগঞ্জ জেলা, উত্তর-পশ্চিমে মেঘনা নদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলা, উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা এবং পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ অবস্থিত।
চিত্রঃ বাংলাদেশের মানচিত্রে কুমিল্লা জেলা
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এই জেলার মোট জনসংখ্যা ৫৬,০২,৬২৫ জন।
প্রশাসনিক পটভূমি
কুমিল্লা জেলার পূর্ব নাম ত্রিপুরা। প্রাচীনকালে কুমিল্লা জেলা সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিলো এবং পরবর্তীতে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হয়েছে। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শন থেকে যতদূর জানা যায়, খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে ত্রিপুরা গুপ্ত সম্রাটদের অধিকারভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, সপ্তম থেকে অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বৌদ্ধ দেববংশ রাজত্ব করে। নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা হরিকেলের রাজাগণের শাসনাধীনে আসে। দশম হতে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বছর এ অঞ্চল চন্দ্র রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছে।
১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে, বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে এর সমতল অংশ সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে, ঢাকা নিয়াবতের (উপ-প্ৰদেশ) অংশ ছিল কুমিল্লা। ঐ সময়ে দিওয়ানি মঞ্জুরির মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র অধীনে আসে এই অঞ্চলটি। এর পূর্ববর্তী সময়ে মোঘলদের দ্বারা শাসিত হয়েছে কুমিল্লা।
১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে কোম্পানী একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে। তখন কুমিল্লা ঢাকা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টিপেরা বা ত্রিপুরা জেলা গঠন করে। এই জেলায় অধিভুক্ত হয় বর্তমান সরাইল ব্যতিরেকে বৃহত্তর কুমিল্লা এবং বর্তমান বৃহত্তর নােয়াখালী জেলা।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে, রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত প্রশাসনিক কাজে সুবিধার জন্যে ত্রিপুরাকে স্বতন্ত্র জেলা করা হয়।
১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে, ময়মনসিংহ থেকে আমিরাবাদ ভালুকাকে কেটে এই জেলাভুক্ত করা হয়। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে, ত্রিপুরা জেলা থেকে পৃথক করে নােয়াখালীকে জেলার মর্যাদা দেয়া হয়। ওই বছরেই দক্ষিণ শাহবাজপুর ও কয়েকটি দ্বীপকে ত্রিপুরার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে সরাইল, দাউদপুর, হরিপুর, বিজোরা ও বর্তমান ব্ৰহ্মণবাড়িয়া জেলার পশ্চিমাঞ্চলকে ময়মনসিংহ হতে বাদ দিয়ে ত্রিপুরার সাথে যুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে, ছাগলনাইয়া কে ত্রিপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবরে, ত্রিপুরা জেলা নামে অভিহিত হয়ে আসা এই জনপদটি কুমিল্লা জেলা হিসাবে প্রশাসনিকভাবে পৃথকীকৃত হয়।
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে, কুমিল্লার দু’টি মহকুমা চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পৃথক জেলা হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়।
শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির পাদপীঠ কুমিল্লা প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে এ উপমহাদেশে সুপরিচিত। কুমিল্লার খাদি শিল্প, তাঁত শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎ শিল্প ও কারু শিল্প, রসমালাই, মিষ্টি, ময়নামতির শীতল পাটি ইত্যাদি স্ব-স্ব ঐতিহ্যে স্বকীয়তা আজও বজায় রেখেছে।
বর্তমানে কুমিল্লা জেলা ২৭ ওয়ার্ড বিশিষ্ট ১টি সিটি কর্পোরেশন, ১৭টি উপজেলা, ১৮টি থানা, ৮টি পৌরসভা, ১৯২টি ইউনিয়ন, ৩,৬৮৭টি গ্রাম নিয়ে গঠিত।
নামকরণের ইতিহাস
কুমিল্লা জেলার পূর্ব নাম ছিলো ত্রিপুরা। জানা যায়, ত্রিপুরা নামক একজন প্রতাপশালী রাজার নামানুসারে ত্রিপুরা রাজবংশ পরিচিত হতে থাকে এবং তারই নামে ত্রিপুরা জেলার নামকরণ হয়।
অনেকের ধারণা, ত্রিপুরা শব্দটি নিকটেরই পাহাড়ী ত্রিপুরা রাজ্যের নাম থেকে এসেছে।
কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন কাহিনী হতে জানা যায়, ঋকবেদ-এর তথ্যানুসারে সপ্ত মহাদেশের সম্রাট যযাতি-র পৌত্র ‘ত্রিপুরা’র নাম থেকে এই জেলার নামের উৎপত্তি।
কেউ কেউ এমন মতামত পোষণ করেন যে, “তুই-প্ৰা” বাক্যটি থেকে ত্রিপুরার উৎপত্তি ঘটেছে। ‘রাজমালা’ গন্থকারের মতে, এই পাহাড়ী ভাষায় “তুই-প্ৰা” বাক্যের অর্থ হচ্ছে সমুদ্রমুখী’ বা ‘সাগরের দিকে ধাবমান’ । পাহাড়ীরা চলতি দ্রুতকথনে “তুই-প্ৰা” কে তি-পরা, উচ্চারণ করতেন, সেই থেকে কালের বিবর্তনে ‘ত্রিপুরা’ শব্দটি এসেছে। তুই-প্ৰা > তুইপ-রা > তিপরা > তিপুরা > ত্রিপুরা।
কেউ বলে থাকেন যে, তিন নগরী বা তিনপুর অর্থে ত্রিপুর অথবা ত্রিপুরেশ্বরী দেশ হিসাবেও এই নাম আসতে পারে ।
আবার ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে, জন ডি ব্যবোস অঙ্কিত আঞ্চলিক মানচিত্রে ‘ট্রোপই’ নামক একটি স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ‘ট্রোপই’ ই ত্রিপুরা’র আদি শব্দ বলে মনে করেন অনেকে।
ত্রিপুরা কিভাবে কুমিল্লা হলো সে বিষয়ে হরেক রকম কল্পকাহিনী এবং কিংবদন্তির প্রচলন রয়েছে।
কথিত আছে যে, চৌদ্দশ শতকে আহমেদ কবির-এর ভাগ্নে হযরত শাহ্ জামাল ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে আসেন। তখন তার মামা আহমেদ কবির তাকে একমুঠো মাটি দিয়ে আদেশ করেন, যেথাকার মাটির রং, গন্ধ এবং স্বাদ এই মাটির সাথে হুবহু মিলে যাবে; সেই স্থানটিকেই যেন শাহ্ জামাল তার ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসাবে গ্ৰহণ করেন। শেষপর্যন্ত বর্তমান কুমিল্লা শহরের নিকটে গাজীপুর মহল্লার খিলাতলী নামক স্থানের মাটির রং, গন্ধ এবং স্বাদের সাথে তার মামার দেয়া মাটির মিল খুঁজে পান তিনি। তখন সফল হবার আনন্দে হযরত শাহ জামাল ‘কোহ মিলা-কোহ মিলা’ বলে আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন। যার অর্থ ‘কাজিখত পাহাড় (বা উচ্চভূমি) পাওয়া গেছে’। এই “কোহমিলা’ থেকেই নাকি এলাকার নাম রাখা হয় “কোহমিলা’। আর কোহমিলা হতেই কালপরম্পরায় কুমিল্লা” শব্দটির উৎপত্তি ঘটে। কোহমিলা > ক্যোমিলা > কোমিলা >কুমিলা > কুমিল্লা।
আরো একটি উপকথার মাধ্যমে জানা যায়, এ অঞ্চলে টিপরা (পরে উচ্চারণ পরম্পরায় ত্রিপুরা’ হয়) রাজার স্ত্রীর নাম ছিল “কমলা’। কুমিল্লা” শব্দটি উৎপত্তির মূল বা মা-শব্দ এই ‘কমলা’।
অন্য কিংবদন্তি অনুসারে, ষোল শতকে কুমিল্ল নামে একজন ব্যক্তি শাসক হিসাবে এই অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলেন। তার নাম অনুসারেই এই জেলার নাম হয় কুমিল্লা।
এ ধরনের আরো কিংবদন্তির প্রচলন আছে যে, দ্রুপিয়ান কলিংস কুমিল্লার নিকটে ‘কামালঙ্ক’ নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই থেকে ধারণা করা হয়, এই কামালঙ্ক’ থেকেই ‘কুমিল্লা” নামটির উৎপত্তি হয়ে থাকবে।
আরো কিছু তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলো হলো, বাংলাদেশের পূর্ব অঞ্চলের প্রাচীনকালীন নাম ছিল “কিয়াতস’। চীনদেশের পরিব্রাজক ওয়ান চােয়াং তার মাতৃমাষায় এতদঞ্চলের ভ্রমণ বিষয়ে লিখতে গিয়ে “কিয়ামলঙ্কিয়া” নামী একটি জনপদের কথা উল্লেখ করেছেন। যাকে তিনি বলেছেন সমতট রাজ্যের পূর্ব-দক্ষিণভাগে সাগর তীরের দেশ। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন ওয়ান চােয়াং-এর এই “কিয়ামলঙ্কিয়াই উচ্চারণাঞ্চলিক দোষে পূর্বোক্ত ‘কমলাঙ্ক’ এবং কমলাঙ্ক থেকে ‘কুমিল্লা” রূপ ধারণ করেছে।
দর্শনীয় স্থান
কুমিল্লা জেলার চিত্তাকর্ষক স্থান ও স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ- অভয় আশ্রম; আনন্দবিহার; উজিরপুর টিলা; কোটবাড়ি; কোটবাড়ি মুড়া; চন্ডী মুড়া; জগন্নাথ দীঘি, লাল মাঠ; ধর্মসাগর; নবাব ফয়জুন্নেসা জমিদার বাড়ি; ভাউকসার জমিদার বাড়ি; ময়নামতি; রাজেশপুর ইকোপার্ক; রাণী ময়নামতি প্রাসাদ ও মন্দির; লালমাই চন্ডী মন্দির; লালমাই পাহাড়; শালবন বৌদ্ধ বিহার এবং শাহ সুজা মসজিদ ইত্যাদি।
চিত্রঃ নবাব ফয়জুন্নেসা জমিদার বাড়ি
চিত্রঃ শালবন বিহার
কৃতি ব্যক্তিত্ব
কুমিল্লা জেলার কৃতি ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেনঃ- ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মেয়র আতিকুল ইসলাম; বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী’ প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান; বাংলাদেশের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল; আপেল মাহমুদ; বীর প্রতীক আবদুল গণি; আশা দাশগুপ্ত; বীর বিক্রম এ কে এম সামসুল হক খান; খন্দকার মোশাররফ হোসেন; বুদ্ধদেব বসু; বীর উত্তম মঈনুল হোসেন; বীর প্রতীক মনসুর আলী; সুফিয়া কামাল; শচীন দেববর্মণ; চিত্রশিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী এবং কয়েকজন সফল অভিনেতা ও অভিনেত্রী সহ আরো অসংখ্য ব্যক্তিবর্গ।
তথ্যসূত্রঃ
১. বাংলাপিডিয়া
২. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Very informative!!