ভুলে যাওয়া আমেরিকান মুসলিমদের ইতিহাস

বিশ্বের বর্তমান মোড়ল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা দেশটির নাম আমেরিকা। যার সদ্য বিগত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি সহ নানা মন্তব্যই সরাসরি সে অঞ্চলে অবস্থান করা মুসলিমদের দিকে আঙ্গুল তুলে করা হয়,এছাড়াও সে অঞ্চলে এমন বেশ কিছু সিনেটরই রয়েছে যাদের মূল নির্বাচনী ইশতেহারই পাওয়া যায় মুসলিম হটাও মর্মে। এমনই এক বিখ্যাত চরম ইসলাম বিদ্বষী নারী পামেলা গেলার যার আন্দোলনের নামই হলো “stop islamization of america”। এরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রশ্ন তুলে তাদের আমেরিকান হওয়া নিয়ে। এ মর্মে প্রচার করে যে তারা মাত্র কিছুদিন আগে সাগরের তীরে ভেসে আসা কিছু বহিরাগত অভিবাসী রূপে এদেশে ঠাই নেয়া এক জাতি। অবস্থা যখন এই খোদ আমেরিকারই নানা ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের প্রফেসররা খোঁজা শুরু করে তাদের অতীত ইতিহাস। ইতিহাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে যা তাদের সামনে আসে তা সত্যিই অবাক করার মতো।
জানা যায় যে মুসলিম জাতিকে আমেরিকায় আগত কিছু বহিরাগত নামে আখ্যা দেয়া হচ্ছিল সে জাতিটির ইতিহাস আমেরিকা আবিস্কারের চেয়েও পুরোন। ইতিহাস যাকে আমেরিকার আবিস্কারক হিসেবে জানে কলোম্বাস তার আগ থেকেই মুসলিমদের ট্রেস পাওয়া যায় সে অঞ্চলে।

১১৭৮ সালের ” সং সাম্রাজ্যের” সিরকা নামক এক চাইনিজ লিখিত একটি দলিল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, যা sung document নামে পরিচিত। যা থেকে জানা যায়, ১১৭৮ সালে চীন থেকে যাত্রা করে একদল মুসলিম নাবিক যা বর্তমান আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া এলাকায় পৌছে যায়। যা দ্বারা প্রমাণিত হয় মুসলিমরা কলোম্বাসের পূর্বেই আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছিল।
এছাড়াও ব্রিটিশ নৌ ইতিহাস গবেষক “গ্যাভিন মানজিস” তার “1421” শিরোনামের বইয়ে উল্লেখ করেন “ঝেং হি” নামক একজন চাইনিজ মুসলিম নাবিক কলোম্বাসের ৭১ বছর পূর্বেই আমেরিকায় গিয়েছিলেন।
এত গেল আবিস্কারের পূর্বের কথা আবিস্কারের পর মুসলিমদের আমেরিকায় অবস্থান মূলত দাসদের অবস্থানের ইতিহাস। আমেরিকায় মুসলিমদের বেশিরভাগই ছিলো দাস।
এ সম্বন্ধে “এ হিস্টোরি অব ইসলাম ইন আমেরিকা” বইটিতে ক্যাম্বিস ঘানিবাসিরি উল্লেখ করেন আমেরিকায় মুসলিমরা এসেছিলেন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে।
তেমনই একজন মানুষের খোঁজ ইতিহাসে পাওয়া যায় যার মৃত্যু ঘটে ১৫৩৯ সালে। মুস্তফা আল-জামুরি নামক সে ব্যাক্তিটিকে আমেরিকার দক্ষিণ পশিচামঞ্চলে দাস হিসেবে ধরে আনা হয়। একজন মুসলিম চিকিৎসক ও ওষুধ বিশারদ মুস্তফা আল-জামুরি ইসলাম প্রচার ও ঈমান রক্ষার সংগ্রামে আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন।
১৬১৯ সাল থেকে আমেরিকায় দাস-দাসীর আমদানী শুরু হয়। আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাস-দাসীর ৩০ ভাগই ছিলো মুসলিম। আমেরিকায় তাদের জীবন-যাপন ছিলো অত্যন্ত করুণ। নিজ ইচ্ছানুযায়ী ধর্ম-কর্ম পালন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। অনেক মুসলিম দাস-দাসীকে জোড় করে খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হত। অনেকে গোপনে যতটা সম্ভব ধর্ম-কর্ম পালনের চেষ্টা করতেন।
দাস হিসেবে নিয়ে আসা অনেক মুসলমানই ছিলেন শিক্ষিত সেরকমই একজন মানুষ ছিলেন আইয়ুব বিন সোলাইমান, যাকে ১৭৩১ সালে গাম্বিয়া থেকে নিয়ে আসা হয়। মানুষটি নিজ অধিকার সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ও বিচক্ষণ ছিলেন। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের পর নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন মানুষটি। তার সম্বন্ধে থমাস ব্লুয়েট নামক একজন তৎকালীন আইনজীবি বলেন ;
“তিনি আল্লাহ ও মুহাম্মদ শব্দ উচ্চারণ করলেন। তিনি এক গ্লাস মদ গ্রহণে অস্বীকার করলেন যা আমরা তাকে দিয়েছিলাম। আমরা বুঝলাম তিনি সাধারণ কেও নন তিনি ” মুহাম্মাডান”।

এছাড়াও বিলালি মুহাম্মদ, ওমর সহ এরকম আরো বহু মানুষের সন্ধান পায় গবেষণা টিম। আইনগত ভাবে মুসলিমরা প্রথম অধিকার পায় ১৭৯০ সালে। সাইথ ক্যারোলাইনার একটি লেজিসলেটিভ বডি একটি special legal stutus অনুমোদন করে। এছাড়াও ১৭৯০ সালেই “moons sundry act ” স্বাক্ষরিত হয়।
উনিশ শতকের দিকে আমেরিকায় ছিলো না কোন অভিবাসন আইন মাত্র ৫০ সেন্টের বিনিময়ে পাওয়া যেত সেখানকার নাগরিকত্ব। এছাড়াও শিল্পবিল্পপ সহ নানাকারণে মানুষ সে সময়কালে বেশ অনেক হারে পাড়ি জমাতে থাকে সে দেশটিতে।
সে সকল কমিউনিটির কোন একটির হাত ধরেই আমেরিকার মাটিতে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। ইতিহাসবিদ “শেলি হাওলের ” মতে আমেরিকায় প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয় ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে।
আস্তে আস্তে মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হওয়া শুরু করে ১৮৯৯ সালে হাসান জুমআর প্রচেষ্টায় ত্রিশটি পরিবারের সমন্বয়ে নর্থ ডাকোটা অংগরাজ্যে প্রথম কোন মুসলিম কমিউনিটি প্রতিষ্টিত হয়।কমিউনিটি প্রতিষ্ঠার এ ধারা আজ পর্যন্ত অব্যবহিত থামে নি, যারা মুসলিমদের এক করে রেখেছে এবং পাশ্চাত্য ভূমিতে ইসলামকে প্রসারিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই দেখা যায়, সেখানকার মুসলিমরা অনেক ছোট ছোট মুসলিম কমিউনিটি বানাতে শুরু করেন। শেলি হাওয়েলের ভাষ্য অনুযায়ী সে সময়টাতে অসংখ্য আফ্রো-আমেরিকান মুসলিম হতে শুরু করে যাদের বাপ-দাদাদের ক্রীতদাস হিসেবে এ দেশে ধরে আনা হয়েছিল। আমেরিকান সমাজে কালো মানুষদের যেখানে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হত ইসলাম সেখানে সকলের মাঝে সাম্যের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটেএ দশকে আমেরিকায় কালোদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন শুরু হলে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ইসলাম।
বিংশ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই সেখানকায় ১১ লক্ষাধিক মুসলম প্রবেশ করে। অবস্থা বদলে যায় ১৯৬৫ সালের পর থেকে। আমেরিকা সে সময় বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯৬৭ সালে আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের বিখ্যাত ‘ছয় দিনের যুদ্ধ ‘ চলাকালে আমেরিকান গণমাধ্যম আরব দেশ ও মুসলিম দের সম্পর্কে নেতিবাচক খবর তুলে ধরা শুরু করে। শুরু হয় আমেরিকানদের মুসলিম দের নিয়ে নেতিবাচক চিন্তাভাবনার শুরু।
চিন্তাভাবনায় সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ২০০১ সনের সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ হওয়া সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যেদিন কিছু উগ্রবাদী জঙ্গীরা আত্বঘাতী হামলার মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয় টুইন টাওয়ার। এ ঘটনা আমেরিকান মুসলিমদের সামাজিক অবস্থানে তীব্র আঘাত হানে। আমেরিকানরা মুসলিমদের তীব্রভাবে বিদ্বেষ পোষণ শুরু করে।
পিও রিসার্চ অনুযায়ী মানুষ যে হারে ধর্মান্তরিত হচ্ছে ইসলামে এবং মুসলিম মায়েদের সন্তান জন্ম দানের সক্ষমতার হার সকল কিছুর বিবেচনায় ২০৫০ সালের মধ্যেই যার সংখ্যা ৯০ লাখ ছাড়াবে যখন দেশটির দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পাবে ইসলাম।

আমেরিকা প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই যে জাতিটি আমেরিকার সাথে সম্পর্ক্ত সে জাতিকেই বহিরাগত হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ধর্মীয় জাত্যাভিমানকে উসকে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে এ ধরণের প্রবণতা সৃষ্টি করেছে কিছু রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহল। সদ্য প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট “ডোনাল্ড ট্রাম্প” কেও এর বাহিরে বলা চলে না।
মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ খাঁন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরো পড়ুন;
আল-কুরআনে বর্ণিত বিস্ময় প্রাণী “উটের” অদ্ভূত সৃষ্টিতত্ব বিশ্লেষণ; https://bit.ly/3q7yL7r