ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জেলা বগুড়া

বগুড়া জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এই জেলা কে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এই টি জেলা দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে অত্যধিক পরিচিত।
বগুড়া জেলার মোট আয়তন ২,৮৯৮.২৫ বর্গ কি.মি.। এই জেলার উত্তরে গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট জেলা, দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলা, পূর্বে জামালপুর জেলা ও যমুনা নদী এবং পশ্চিমে নওগাঁ জেলা অবস্থিত ।
চিত্রঃ বাংলাদেশের মানচিত্রে বগুড়া জেলা
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এই জেলার মোট জনসংখ্যা ৩৫,৩৯,২৯৪ জন।
প্রশাসনিক পটভূমি
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, বগুড়া জেলা ছিল প্রাচীন বাংলার ‘পুণ্ড্রবর্ধন’ এর রাজধানী। যা বর্তমানে ‘মহাস্থানগড়’ নামে পরিচিত।
চিত্রঃ ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়
ইতিহাসের পাতায় হিন্দু আমল, সুলতানী আমল, নবাবী আমল, বৃটিশ আমল ও পাকিস্তান আমল পেরিয়ে এই বাংলাদেশ পর্যন্ত বগুড়ার অনেক কাহিনি বিস্তৃত আছে।
যা থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলটি ৯ম শতক থেকে ১২শ শতক পর্যন্ত সেন রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়। পরে ১৩শ শতকের শুরুতে তা মুসলিম শাসকদের অধীনে আসে।
১৮২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, উত্তর বঙ্গের এই অঞ্চলটি প্রশাসনিকভাবে রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। এই তিনটি জেলা ই ছিল আয়তনে বিশাল। পরবর্তীতে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে, রাজশাহী জেলা থেকে আদমদিঘি শেরপুর নৌখিলা ও বগুড়া থানা; রংপুর জেলা থেকে দেওয়ানগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জ থানা; দিনাজপুর জেলা থেকে লালবাজার, ক্ষেতলাল ও বদলগাছি থানা নিয়ে বগুড়া জেলা গঠিত হয়।
জনশ্রুতি আছে যে, ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে করতোয়া নদীর তীরে ইংরেজরা বগুড়া জেলার পত্তন ঘটিয়েছিল। মূলত এই অনুমানের ২৮ বছর পরে, ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বগুড়া জেলা গঠিত হয়। যদিও এটা সত্য যে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে, বৃটিশ কর্তৃক এই মহকুমাকে ‘বগুড়া জেলা’ হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়।
১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে, রাজশাহী জেলার রায়গঞ্জথানা ও বগুড়া জেলার অধীনে আনা হয়। কিন্তু বিশাল আয়তনের ফলে রাজস্ব আদায়ে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ময়মনিসংহ ও রাজশাহী জেলা থেকে ৫৪৯ টি জমিদারি বগুড়া কালেক্টরের অধীনে আনা হয়। এখান উল্লেখ্য যে, এর আগে বগুড়ার অধীনে ২৮৭টি জমিদারি ছিল। এই অধিভুক্তির ফলে বগুড়ার প্রশাসনিক আয়তন বৃদ্ধি পায়। আয়তন বৃদ্ধির ফলে ১৮৫০ সালেই বগুড়া জেলা শহর প্রতিষ্টা করা হয়।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি, তৎকালীন ভারত সরকারের আদেশ অনুযায়ী দাওকোবা নদী কে বগুড়া জেলার পূর্বসীমা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে, বাউন্ডারি কমিশনারের নির্দেশানুসারে বগুড়া জেলার দক্ষিণ সীমানার কিছু অংশ রাজশাহী জেলার অন্তর্গত হয়। এই সময় ভাদ্রাবতী নদীকে বগুড়ার সীমানা নির্ধারিত করা হয়। এই বৎসরের ই ১২ আগষ্ট, বগুড়ার গোবিন্দগঞ্জ থানাকে রংপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় ১০২ টি গ্রামকে গোবিন্দগঞ্জ থানার অধীনে নেওয়া হয় এবং এই থানার ৯ টি গ্রামকে বগুড়া থানায় রাখা হয়।
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর, ৪৩৯টি গ্রাম ময়মনিসংহ জেলা থেকে নিয়ে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি থানার সাথে যুক্ত করা হয়। এই বৎসর শিবগঞ্জথানা বগুড়া থানার আউট পোষ্টে পরিগণিত হয়।
১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে, বগুড়া জেলার একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন কালেক্টরের শাসনাধীনে আনা হয়। এই নিয়োগের ফলে বগুড়া একটি পূর্ণাঙ্গ জেলায় পরিণত হয়।
বগুড়া পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৮৪ সালে।
বগুড়া জেলা ১২ টি উপজেলা, ১২ টি পৌরসভা, ১০৮ টি ইউনিয়ন, ১,৭৫৯ টি মৌজা ও ২,৬৯৫ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত।
নামকরণের ইতিহাস
ভারতের রাজা “আশকা” বাংলা জয় করার পর এই অঞ্চল টির নাম রাখেন পুণ্ড্রবর্ধন।
বগুড়া নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা যায়, ১২৮১-১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লরি সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের ২য় পুত্র সুলতান নাসিরউদ্দীন বগরা খান বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তার নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম হয়েছিল ‘বগড়া’। কালের বিবতর্নে ‘বগড়া’ নামটি পরিবর্তিত হয়ে ‘বগুড়া’ শব্দে পরিচিতি পেয়েছে।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে কালের বিবর্তনে বাংলা নামটির পরিবর্তন ঘটলেও ইংরেজি নাম ( Bogra) টির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি তখন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) বৈঠকে বগুড়ার ইংরেজি নাম Bogura করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
আরেকটি মত হল, বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের স্থানিক নাম ছিল ‘বগ্ড়ী’। সেটা রাজা বল্লাল সেনের আমল। সেই আমলে বঙ্গদেশকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। বঙ্গ, বরেন্দ্র, মিথিলা, বাঢ় ও বগ্ড়ী। শেষের ‘বগ্ড়ী’ অংশে নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ‘বাগিদ’দের সংখ্যাগুরুত্ব ও অধিক শক্তিমত্তা ছিলো। এই বাগদি শব্দটিই অপভ্রংশ ‘বগ্ড়ী’ রূপ ধারণ করতে পারে। কালে রূপান্তরিত এই ‘বগ্ড়ী’ই ‘বগুড়া‘ উচ্চারণে স্থির হয়েছে বলে একটি ধারণা রয়েছে। যদিও এ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। কারণ, বগুড়ার অবস্থান বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে নয়।
তাই নাসিরউদ্দীন বগরা খান এর নামানুসারেই ‘বগুড়া’ জেলার নামকরণ হয়েছিলো মত টি অধিক গ্রহনযোগ্য।
চিত্তাকর্ষক স্থান ও পর্যটন আকর্ষণ
বগুড়া জেলার চিত্তাকর্ষক স্থান ও স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মহাস্থানগড়; গোকুল মেধ (বেহুলা লক্ষিণদ্বরের বাসর ঘর); ভীমের জাঙ্গাল; খেরুয়া মসজিদ; মানকালীর কুন্ড ধাপ; সান্তাহার সাইলো; শীলাদেবীর ঘাট; মহাস্থান প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর; গবিন্দ ভিটা; দেওতা খানকা হ্ মাজার শরীফ; ভাসু বিহার; ভীমের জাঙ্গাল; পরশুরামের প্রাসাদ; যোগীর ভবন ইত্যাদি।
চিত্রঃ খেরুয়া মসজিদ
চিত্রঃ মানকালীর কুন্ড ধাপ
বগুড়া জেলার উল্লেখযোগ্য নদী
বগুড়া জেলার প্রধান নদী সমূহ হচ্ছে; করতোয়া, যমুনা, বাঙ্গালী ও নাগর নদী। এছাড়াও আরো উল্লেখযোগ্য নদী হচ্ছে হলহলিয়া, ইছামতি, মহিষাবান, সুখদহ, ডাকুরিয়া, বেলাই, ভাদাই/ভদ্রাবতী, চন্দ্রবতী, গাংনই, গজারিয়া মানস/মোনাস, বানিয়াইয়ান, ইরামতি ও ভেলকা নদী।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব
বগুড়া জেলার কৃতি ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়াউর রহমান; ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলনের নেতা প্রফুল্ল চাকী; পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী; বীর উত্তম খাদেমুল বাশার; সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস; লেখক এবং সাংবাদিক এম. আর. আখতার মুকুল; ভাষা সৈনিক গাজিউল হক; জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় মুশফিকুর রহিম; বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
তথ্যসূত্রঃ
১. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন
২. দৈনিক ইত্তেফাক
৩. জেলা পরিষদ, বগুড়া
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়