আল-কুরআনে বর্ণিত বিস্ময় প্রাণী “উটের” অদ্ভূত সৃষ্টিতত্ত্ব বিশ্লেষণ

১৪০০ বছর আগে মানবজাতিকে লক্ষ্য করে এ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এক প্রশ্ন করেছিলেন আল-কুরআনের সূরা গাশিয়াতে ” তাহলে কি এরা উটগুলো দেখছে না? কিভাবে এদের সৃষ্টি করা হয়েছে? ” এখন প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবীতে এত লক্ষ লক্ষ প্রাণি থাকা সত্তেও আল্লাহ সুবাহানাহূ ওয়া তায়ালা কেন মানবজাতির চিন্তাধারাকে উটের সৃষ্টিপ্রণালির দিকেই আকৃষ্ট করলেন? আজকে আমরা এ প্রশ্নেরই উত্তর খোজার চেষ্টা করব।

উট এই সৃষ্টিজগতে সকল প্রাণির মাঝে সর্বাধিক বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য সম্বলিত বলে বিজ্ঞানিরা বিবেচনা করে থাকেন।
ধারণা করা হয় উটের পূর্বপুরুষরা উত্তর আমেরিকায় প্রথম আবির্ভূত হয়। এরপর “আইস এইজ” শুরু হলে বেরিং প্রণালির উপর বরফের ব্রিজ তৈরি হলে তা অতিক্রম করে বহু বছর আগে এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় প্রবেশ করে ড্রোমেডারি ও বাক্ট্রিয়ান জাতের উট অন্য একভাগ তথা লামা ও ভিকুনা জাত চলে যায় দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলে।
আমরা উটকে জানি মরুভূমির জাহাজ রূপে । মরুভূমিতে আসলে উটই রাজা। মরুভূমির ওই ভয়ানক তাপমাত্রা, পানির ভয়াবহ সংকট, জীবন ধারণের কাঠিন্যতায় ঠাসা পৃথিবীর বিশাল একটি অঞ্চল ঘিরে রাখা এই মরুভূমিকে জয় করার ক্ষমতা প্রকৃতি কেবল এই উটকেই দু’হাত ভরে দিয়েছে। এর সৃষ্টি প্রণালি আসলেই চমকপ্রদ।

একটি পূর্ণ বয়স্ক উটের ওজন হয় ৪৫০-৬০০ কেজি পর্যন্ত। উচ্চতা প্রায় ২ মিটার হয় । এত বিশাল ভারি শরীরকে বহন করার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন পড়ে শক্তিশালী পায়ের। উটের ক্ষেত্রে তার এই ‘পা’ তাকে মরুভূমিতে অপরাজেয় ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছে। উটের ক্ষেত্রে তার চারটি পা’ই ভীষণ সুগঠিত, শক্তিশালী এবং লম্বা হয়। প্রতিটি পায়ের পাতাই চওড়া, চর্বি ও নমনীয় ফাইবারের পুরু আস্তরণ থাকে যা লোম দিয়ে ঢাকা থাকে। উটের পায়ের পাতা দেখতে অনেকটা জুতোর সোলের মত বলে একে ‘সোল প্যাড’ বলা হয় । উটের পায়ে থাকা এই সোল প্যাডের কারণেই উট ভয়ানক তপ্ত বালুতেও অনায়াসে হাটতে পারে । উটের পায়ের এই সোল প্যাড অবিশ্বাস্য রকমের মোটা হয়। যার কারণে উট শুধু তপ্ত বালু নয় কোন রকমের বাহ্যিক অনূভুতি ব্যাতীতই তপ্ত বালু কিংবা বরফের উপর দিয়ে হেটে যেতে পারে।
উটের দৃষ্টিশক্তিও বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছে। দৃষ্টিশক্তি এর এতটাই প্রখর যে দিনে-রাতে অনায়াসে দেখতে পারে। মরুভূমির ভয়ানক বালুঝড়েও সুন্দরভাবে তাকিয়ে থাকতে পারে, যা সম্ভব হয়েছে এর চোখের উপর থাকা বিশেষ ধরণের লোমের কারণে।
মরুভূমির বিপদসংকুলতার কথা চিন্তা করেই যেন সৃষ্টিকর্তা অপরূপ ভাবে সৃষ্টি করেছেন এ প্রাণীকে যার অন্যতম নিদর্শন এ প্রাণিটির কান। উটের কান গুলো ছোট হয়, একইসাথে যা ঢাকা থাকে মোটা লোম দিয়ে যাতে মরুঝড়েও কোন বালি প্রবেশ করতে না পারে ।

উটের নাক নিম্নমূখী এবং ঘন লোম দ্বারা আবৃত। যার বৈশিষ্ট্য ধুলো-বালি আটকে গেলেও শ্বাস নিতে কোন প্রকার অসুবিধা হবে না।
উটের গলা লম্বাই না শুধু বাকানোও হয়। মরুভূমিতে অধিকাংশ নিচু উচ্চতার গাছে কাটা অথবা ঝোপ হয়। খাওয়ার মত পাতা বেশ উচুতে হয়। বছরের পর বছর মরুভূমিতে এই লম্বা উচ্চতার গাছের পাতা খাওয়ার কারণেই অভিযোজিত হয়ে উটের গলা লম্বা হয়েছে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।

উটের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক এর কুঁজ। অনেকেই মনে করে থাকেন এর কুঁজে পানি জমা থাকে। কথাটিকে সঠিক বলা যায় না। উটের পীঠের উচু কুঁজটি আসলে একটি চর্বির মস্ত বড় পিন্ড। আমরা জানি, শর্করা অপেক্ষা চর্বি দ্বিগুণ শক্তি দেয়। উট দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকলে কিংবা মরুভূমিতে হাটলে তখন কুঁজের চর্বিগুলো ভাঙতে থাকে। ভেঙ্গে তা ধীরে ধীরব রক্তে চলে যেতে থাকে । রক্ত থেকে শরীরের প্রতিটি কোষে বন্টিত হয়ে এটি শক্তিতে রুপান্তরিত হয়। একারণেই ক্ষুধার্ত উট এবং মরুভুমির পথে দীর্ঘসময় চলা উটের কুঁজ ধীরে ধীরে হেলে পড়ে কিংবা নিস্তেজ হয়ে খাটো হয়ে যায়। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও খাদ্যগ্রহণ শেষে কুঁজটি আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।
উট সম্বন্ধে আরেকটি বিস্ময়কর তথ্য হলো, এটি একনিমিষে মাত্র দশ মিনিটে ২০০ লিটার পর্যন্ত পানি খেতে পারে, যা প্রায় চারটি গাড়ির ফুয়েল ট্যাঙ্কের সমান! এর পর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারে কোনরূপ পানির সমস্যা ছাড়াই৷ এখানে উট ব্যাতীত অন্য কোন প্রাণী হলে অতিরিক্ত পানি গ্রহণ সে প্রাণিটির মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারত, কিন্তু উটের আশ্চর্য সৃষ্টিশৈলির দরুণ এটি এর অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়েছে। সাহারা মরুভূমিতে শীতকালে উট ৬-৭ মাস কোন ধরণের পানি না খেয়েই কাটিয়ে দেয়!
উটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো, এর কাঁটাযুক্ত গাছ চিবানোর ক্ষমতা। বড় বড় ক্যাকটাস গাছ এরা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে! অন্য কোন প্রাণী হলে যেখানে মাড়ি, জিব, গলা কেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত সেখানে এ প্রাণিটির কিছুই হয় না। এর কারণ উটের মুখের ভিতর অজস্র ছোট ছোট শক্ত আঙুলের মত ব্যবস্থা, যা কাঁটার আঘাত থেকে একে রক্ষা করে। এমন এক জিব রয়েছে যা কাঁটা ফুটো করতে পারে না।

সৃষ্টিকর্তা যদি উটকে মানুষের জন্য উপযোগী করে না বানাতেন, তাহলে মরুভূমিতে মানুষের পক্ষে সভ্যতা গড়ে তোলা অনেকটা অসম্ভব হয়ে যেত। এতশত জটিল সৃষ্টিপ্রণালী দ্বারা সৃষ্টিকৃত প্রাণির সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জানতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের ১৪০০ বছর আগেই নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছিলেন যা আধুনিক বিজ্ঞানের বদৌলতে নিত্য-নতুন ভাবে আমাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে এবং আমাদের বিস্ময়ের পারদকে প্রতিনিয়ত আরো উপরে তুলে দিচ্ছে।
মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ খাঁন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরো পড়ুন ;
ak-47 কেন এত জনপ্রিয়? – https://cutt.ly/sjIERON