নিজামুদ্দীন আউলিয়া লিপুঃ পুরনো গাড়ির জাদুকরী রূপান্তর করেন যিনি

নিজামুদ্দীন আউলিয়া লিপু, একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মোটর গাড়ি বিশেষজ্ঞ, ডিজাইনার এবং কোচ বিল্ডার। পুরনো ভাঙাচোরা গাড়িকে পরিবর্তন করে ব্র্যান্ডের গাড়ির মতো করে তৈরি করার পারদর্শিতার কারণেই আলোচনায় আসেন এই ব্যক্তি।
নিজামুদ্দীন আউলিয়া লিপু ১৯৬৮ সালের ১লা অক্টোবর, ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৌদি আরবে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন তিনি। পরবর্তীতে বাবার চাকরির সুবাদে লিপুদের পুরো পরিবার সৌদি আরবে চলে যায়। সেখানে গিয়ে কলেজে ভর্তি হন তিনি।
সৌদি আরবে থাকাকালীন ১৬ বছর বয়সে লিপু তার জীবনের প্রথম মোটর গাড়ি প্রদর্শনী দেখেন। এই প্রদর্শনীতে ছিল বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের গাড়ি। সবগুলো গাড়ির মধ্যে লিপুর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল স্পোর্টস কারগুলো। কিন্তু স্পোর্টস কারগুলোর দাম নাগালের বাইরে থাকায়, সেই মোটর গাড়ি মেলা থেকে তার বাবা তাকে একটি মাজদা ব্র্যান্ডের গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। তবে লিপুর স্পোর্টস কারের প্রতি দুর্বলতা তাতে কমে নি। নিজের সেই স্বপ্ন পূরণ করলেন ১৯৮৯ সালে, সাধারণ একটি সিডান কার ভেঙে ‘ল্যাম্বর্গিনি কাউনটেচ’ তৈরি করার মাধ্যমে।
১৯৯৪ সালের অক্টোবর, তখন লিপুর বয়স ২৬ বছর। সে সময়ই তিনি ‘লিমু-বিল’ নামে তার স্বপ্নের গাড়ি নির্মাণ করে সবাই কে বিস্মিত করেন। তার তৈরি করা এই গাড়িটি ছিলো সত্তর থেকে নব্বই দশকের অন্যতম জনপ্রিয় গাড়ির মডেল ল্যাম্বরগিনি কাউন্টাচের একটি সংস্করণ। সেই সময়ে বডিওয়ার্ক বা পেইন্টস সম্পর্কে একদমই ধারণা না থাকায়, গাড়ি রঙ করার বদলে পোস্টার ব্যবহার করেছিলেন তিনি।
চিত্রঃ লিপুর প্রথম বানানো গাড়ি ‘লিমু-বিল’
২০০০ সালে, তিনি ঢাকায় নিজের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর তিনি তার আরেকটি স্বপ্নের গাড়ি নির্মাণ করেন ‘লিপু’ নামে। যেটি ল্যাম্বরগিনি ডায়াব্লো মডেলের অনুকরণে তৈরি করেছিলেন তিনি। মাত্র ২,৫০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে একটি ডাইহাটসু শ্যারেড গাড়ির মডেলকে অনায়াসেই লিপু-গাড়িতে পরিবর্তন করে তাক লাগিয়ে দেন সবাই কে।
কিন্তু সেটা ছিলো মাত্র শুরু। লিপু অনেক গুলো পুরনো গাড়ি একসঙ্গে জোড়া দিয়ে ২.৮ লিটার সম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিন সহকারে ২২ ফুট লম্বা লিমুজিন গাড়ি বানিয়েছিলেন। এই লিমুজিন বানাতে তার সময় লেগেছিল ৪০ দিন। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ২৮০০ সিসির এই লিমুজিনে অন্যান্য লিমুজিন গাড়ির বিলাসবহুল বৈশিষ্ট্যসম্পন্নও ছিল।
চিত্রঃ লিপুর বানানো সেই “লিমুজিন”
পরবর্তীতে মরিচা পরা আর জং ধরা বাতিল টয়োটা এবং হোন্ডার গাড়ি গুলোর বডি কাটছাঁট করে ফেরারি আর ল্যাম্বরগিনির আদলে নির্মাণ করেন তিনি। তার সেই কনভার্টেড গ্যারেজে চারজন মেকানিক কে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি। তাদের কাজ ছিলো, জাপানি গাড়িগুলোর বডি পার্টস খুলে সেগুলোকে ইতালিয়ান স্পোর্টস গাড়িতে রূপান্তরিত করা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তারা সেখানে যেসব ধাতব শীট ব্যবহার করতেন, সেসবের বেশিরভাগই ব্যবহৃত হতো সাইকেল ও রিকশা বানানোর কাজে।
যদিও তিনি সবসময় ফেরারি গাড়ির একটা লিপু ভার্সন তৈরি করার স্বপ্ন দেখতেন। সে স্বপ্ন কে বাস্তবে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যেই ২০০২ সালের শেষের দিকে, গ্যারেজের চার মেকানিকের সহায়তায় বানিয়ে ফেলেন ফেরারির লিপু ভার্সন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকার রিকশা বানানোর জন্য যেসব ধাতব শিট ব্যবহার করা হয়, তিনিও তা ব্যবহার করেছিলেন এ গাড়ি নির্মাণে। গাড়িটি তৈরি হয়ে গেলে পরে তিনি নাম দেন ‘স্বাধীনতা ৭১’।
নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে লীপুর তৈরি করা ফেরারি গাড়ি প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি সবার নজর কাড়েন।
নিজের কাজ নিয়ে লিপুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সিনডেরেলার কথা মনে আছে? রূপকথার সেই গল্পে সিন্ড্রারেলা যখন বল ড্যান্সে যেতে চায়, তখন তার গডমাদার ওকে কুমড়ো থেকে একটা গাড়ি বানিয়ে দেন। আমি লিপুও সেরকমই। আমাকে যত পুরনো গাড়িই এনে দেন না কেন, সেটাকে আধুনিক রূপদান করাই আমার কাজ”।
লিপু এবং তার মেকানিক দের সফলতা এসেছিল ‘স্বাধীনতা ৭১’ গাড়িটি দিয়েই। গাড়িটি নির্মাণের পরপরই বিবিসির একজন সাংবাদিক লিপু আর তার গাড়ি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘স্বাধীনতা ৭১’ নামের এই গাড়িটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পায় ‘দ্য বাংলাদেশি ফেরারি’ নামে। এমনকি ফেরারির অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও গাড়িটি প্রদর্শিত হয়। এই সাফল্যই লিপুকে অটোমোবাইলে উচ্চতর শিক্ষালাভের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
সেই উদ্দেশ্যেই পরবর্তীতে আমেরিকার মিশিগানের জেনারেল মোটরস ইন্সটিউটিউতে যান তিনি। সেখানে প্রযুক্তিগত কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নিজের পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়েছিল। সেখান থেকেই বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে তিনি নিজের কর্মশালা খোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিন বছর এখানে কাজ করে নিজের ব্যবসার উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশে ফিরে যান তিনি। দেশে এসে লোকজনের পছন্দমাফিক গাড়ি বানিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করলেন তিনি। সেখানে পুরনো ডাইহাটসু আর টয়োটার উপর ভিত্তি করে লিপু গাড়ি নির্মাণের জন্য অর্ডার নেয়া শুরু করেন আউলিয়া।
চিত্রঃ বামদিকের গাড়িটিকেই ডানদিকের গাড়িতে রূপান্তরিত করেন তিনি
২০০৪ সালে, ইন্টারসেকশন ম্যাগাজিনের নজর পড়ে লিপু এবং তার তৈরিকৃত গাড়ির উপর। এর পরপর ই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে তার। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত, যুক্তরাজ্যের ঢাকা সিটি প্রদর্শনীতে শুধু তাকেই ফিচার করা হয়। ২০০৬ সালে, ডিসকভারি চ্যানেল লিপুকে প্রস্তাব দেয়, দু’ সপ্তাহের মধ্যে দু’টি গাড়ি যে করেই হোক বানিয়ে দিতে হবে তাকে। তিনি ককনিক কার মেকানিকসের বার্নি ফাইনম্যানের সাহায্য নিয়ে মাত্র সাত সপ্তাহেই দু’টি গাড়ির কাজ সম্পন্ন করে ফেলেন তিনি।
২০০৬ সালের এপ্রিলে, প্রথম গাড়িটি প্রকাশ করা হয় বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্স সেন্টারে।
‘ঢাকা মোটর শো’ নামক অনুষ্ঠানে। এই গাড়িটি ছিল আউলিয়ার স্পোর্টস মডেলের একটি সংস্করণ, এম ২৬। এই স্পোর্টস মডেলের গাড়িটি ছিলো বাইশ বছরের পুরনো এক টয়োটা স্প্রিন্টার মডেলের গাড়ির লিপু সংস্করণ। মাত্র ৪ সপ্তাহে, আমদানি করা চেসিস দিয়ে নির্মিত হয়েছিল এ গাড়ি। একই বছরের ৭ই মে, তার দ্বিতীয় গাড়ি উন্মোচিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে। এই গাড়িটির নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য পিস কার’।
১৯৭৯ সালের টয়োটো ক্রাউনকে এতটাই নিখুঁত ভাবে বদলে ফেলেছেন যে, পুরনো সংস্করণের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না লিপুর ডিজাইনে।
২০০৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় আমন্ত্রণ জানায় তাকে। সেখানে গিয়ে গাড়ির ট্রান্সফরমেশনের কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। একই বছর জুন মাসে লন্ডনের রিচ ম্যাক্স সেন্টারে তার রূপান্তরিত গাড়িটি প্রদর্শিত হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স হিসেবে রেখে দেয় তারা। সেখানে দু’মাস ধরে, একটি ফোর্ড ক্যাপরি গাড়িকে আরো নান্দনিক ডিজাইনে সম্পূর্ণ হাতের কাজের মাধ্যমে প্রস্তুত করেন তিনি। গাড়িটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘কার’ এবং পরবর্তীতে গাড়িটি প্রদর্শনের পাশাপাশি এর নির্মাণের পেছনের ভিডিও প্রকাশ করা হয়।
চিত্রঃ লিপুর ডিজাইনকৃত ‘দ্য পিস কার’
২০০৭ সালের মে মাসে, ‘অ্যাঞ্জেল কার’ নামে আরো একটি লিপু সংস্কারের গাড়ি প্রকাশ করে তারা। যেটি
ব্রুকলিনের প্রবাসী বৈশাখী মেলা উৎসবে প্রদর্শন করা হয়। এটি নির্মাণে আউলিয়া এবং ফাইনম্যান এর সময় লেগেছিলো মাত্র তিন সপ্তাহ।
২০০৭ এবং ২০০৮ সালে, লন্ডনভিত্তিক দু’টি গাড়ির প্রোগ্রামে কাজ করেছিলেন লিপু। এর মধ্যে ডিসকাভারি চ্যানেলের এক ঘণ্টার দুই পর্বের বিশেষ প্রোগ্রাম ‘বাংলা-ব্যাঙ্গার্স’ ছিলো প্রথম টি, যেখানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে লিপুর কাজ সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে দেখানো হয়েছিল। এই প্রোগ্রামে আউলিয়া এবং তার সঙ্গী বার্নি ফাইনম্যানকে নিয়ে ডিসকভারি চ্যানেল দেখায়, কী করে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত যন্ত্রপাতি ছাড়াও তারা একটি পুরনো গাড়িকে সুপারকারে পরিবর্তন করেন। আর এ প্রোগ্রামের ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছিল তার ঢাকার ব্যাকস্ট্রিট ওয়ার্কশপ থেকে। আর পরেরটি ছিল ‘চপ শপ: লন্ডন গ্যারেজ’, যেখানে ডিসকাভারি বিদেশি চ্যানেলগুলোতে এক সিজনের সিক্যুয়েল সিরিজ প্রচারিত হয়। এ প্রোগ্রামের সিক্যুয়েল সিরিজ হিসেবে প্রকাশ পায় ‘চপ শপ: লন্ডন গ্যারেজ’ প্রোগ্রামটি।
দামি গাড়ির পাশাপাশি সুলভ মূল্যে আর হাতের নাগালে থাকে এমন গাড়িও তৈরি করেছিলেন তিনি। ২০১১ সালে, দেশে ফিরে আসার পর তিনি একটি গাড়ি নির্মাণ করেন। নিজের দাদার স্মরণে এই গাড়ির নামকরণ করেন ‘সুরুজ’ নামে। আড়াই লক্ষ টাকা মূল্যের এই গাড়িটির বৈশিষ্ট্য ছিল এটি তেল, গ্যাস এবং এমনকি বিদ্যুতেও চলতে সক্ষম।
চিত্রঃ দাদার স্মরণে করা ‘সুরুজ’
২০১৫ সালে, হিস্টোরি চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘পিটবুল’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান লিপু। সেখানে তারা ‘জাঙ্ক’ বা ‘পুরনো’ গাড়িগুলোকে অর্থের বিনিময়ে কিংবা কাস্টোমাইজ করে পরবর্তী সময়ে তা বিক্রি করে দিতেন। এই রিয়েলিটি শো’র আটটি এপিসোডে তারা সর্বমোট সাতটি গাড়ি কাস্টোমাইজ করেছিলেন।
২০১৩ সাল থেকে, বাবা মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী লিপু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইদাহোর কৌর ডি’অ্যালেবে সস্ত্রীক এবং তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন। তার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে অভিবাসনের সুবিধা দিয়েছে।
সাধারণত গাড়ির ডিজাইনাররা কিছু নিয়ম মেনে একটি গাড়ি তৈরি করেন। প্রথমে গাড়ির নকশা করেন কাগজে। তারপর একে একে লোহালক্কড় পিটিয়ে নিজস্ব ডিজাইনের আকার-আকৃতি দেন এবং এরপর সেগুলো জুড়ে দিয়ে গাড়ি নির্মাণ করে থাকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে নিজামুদ্দিন আউলিয়া লিপুর কাজ ছিলো একদম ই ভিন্নধর্মী। তিনি জানান, এসব করার সময় বা আগ্রহও কোনোটাই নেই।
অহংকারের সঙ্গেই তিনি জানান, এসব কার্যক্রম ছাড়াই একটি গাড়িকে সুপারকার বানাতে পারেন তিনি। তার এ দক্ষতাকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘বাংলা ওয়ে’। এই বাংলা ওয়েতে কাজ করেই তিনি এত এত গাড়িকে সুপারকারে রূপান্তরিত করেছেন।
সবশেষে বলা যায়, প্রবল ইচ্ছাশক্তি ই লিপু কে আজকের লিপু হিসেবে পরিচিত করেছে। নিজের ধৈর্য আর সৃজনশীলতার জোরেই তিনি আজ সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে। সেইসাথে নিজের দেশের মুখও উজ্জ্বল করেছেন তিনি। নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসাই তাকে এনে দিয়েছে জগৎ জোড়া খ্যাতি।
কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়, নিজের কাজ নিয়ে অন্যান্য দেশে যতটা স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং আলোচিত হয়েছেন লিপু, তার ছিটেফোঁটা ও হননি নিজের দেশে। এই দোষ কি লিপুর! নাকি আমাদের! সেই কথা না হয় থাকুক।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়