মিয়ানমারের সেনাপ্রধানঃ সাম্প্রতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু

সম্প্রতি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট এবং ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু চি সহ শাসক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে আটক করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা কমান্ডার-ইন-চিফ মিন অং হ্লেইংয়ের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে৷ এর পরপরই বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচনায় চলে এসেছেন মিয়ানমারের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। অভ্যুত্থানের ফলে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সূর্য উঁকি দিতে না দিতেই আবার কালো মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে। অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতার মসনদে এখন হ্লাইং।
কিন্তু কে এই মিন অং হ্লাইং, চলুন জেনে নেওয়া যাক।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
মিন অং হ্লাইং ১৯৫৬ সালের ৩রা জুলাই বার্মার তাভয় (বর্তমানে দাউই, মিয়ানমার) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বর্তমান বয়স ৬৪ বছর। তার বাবার নাম থাং হ্লেইং, যিনি পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এবং নির্মাণ মন্ত্রণালয়ে কাজ করতেন।
মিন অং ১৯৭২-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত রেঙ্গুন আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন।
১৯৭৪ সালে, তিনবারের প্রচেষ্টায় ডিফেন্স সার্ভিসেস একাডেমিতে যোগ দেন। কিন্তু স্বল্পভাষী ও গম্ভীর ব্যক্তিত্বের জন্য সহপাঠীরা তাকে এড়িয়ে চলত বলে শোনা যায়। ২০১৬ সালে, মিন অং-এর ব্যাপারে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার এক সহপাঠী জানান, তিনি খুবই অল্প কথার মানুষ ছিল, পারতপক্ষে জনসম্মুখেও তেমন আসতো না।
কর্মজীবন
স্নাতক সম্পন্নের পর মিন অং হ্লেইং, মোন রাজ্যে কমান্ডার পদে অধিষ্ঠিত হন।
পরবর্তীতে ২০০২ সালে, তাকে পূর্বাঞ্চলের শান রাজ্যে ট্রায়াঙ্গল রিজিওন কমান্ডের কমান্ডার হিসাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
সৈনিক জীবনের শুরুতে একজন ক্যাডেট হিসেবে তিনি খুব চোখে পড়ার মতো কেউ ছিলেন না।
এ প্রসঙ্গে ২০১৬ সালে, রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিন অং-এর ডিফেন্স সার্ভিস অ্যাকাডেমির ক্লাসের এক সদস্যের থেকে জানা যায়, খুবই ধীরগতিতে তার পদোন্নতি হতো। যার ফলশ্রুতিতে অফিসার কর্পস মিডল র্যাংক ছাড়িয়ে তার পদোন্নতিতে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।
ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি এবং ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক আলিয়ঁস আর্মির মত দুটি বিদ্রোহী দলের মাঝে কেন্দ্রীয় মধ্যস্ততাকারী ছিলেন তিনি।
তিনি মিয়ানমারের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা কাউন্সিলের (এনডিএসসি) একজন সদস্য। এর আগে মিন অং মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম চিফ অব স্টাফ ছিলেন । ২০১১ সালের ৩০ মার্চ, সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তিনি।
২০১১ সালের গোড়ার দিকে, চার তারকা এবং ২০১৩ সালের মার্চে, পাঁচ তারকাপ্রাপ্ত জেনারেল পদে আসীন হন। পদমর্যাদায় তিনি মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্টের সমতুল্য।
২০২১ সালে, সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন।
সেনা কর্মকর্তা থেকে রাজনীতিবিদ
মিন অং হ্লাইং বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে, মিয়ানমারের রাজনৈতিক অবস্থা অনেকটাই অস্থিতিশীল ছিলো। কিন্তু তিনি সেসবে নিজেকে জড়ান নি। অন্যান্য ছাত্ররা যখন বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছেন, তখন তিনি প্রতি বছর ‘ডিফেন্স সার্ভিসেস একাডেমি’ নামক সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলেন।
২০১১ সালের নভেম্বরে, “দ্য ইরাবতীর” প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনা সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে মিন অং হ্লাইংয়ের বৈঠক হয় এবং চীনাদের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি তৈরির ক্ষেত্রে চীনাদের সাথে আলোচনায় তিনি নেতৃত্ব দেন। কাচিন সংঘাতের বিষয়ে চীনের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট শি- জিনপিং এর সাথেও তিনি আলোচনায় অংশ নেন বলে পত্রিকাটি জানায়।
২০১২ এর ২৭ মার্চ, নাইপিদোতে এক বক্তৃতায় তিনি জাতীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর অব্যাহত ভূমিকার উল্লেখ করেন। পরের মাসের ৩ তারিখেই, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক মিন অং-কে ভাইস-সিনিয়র জেনারেল হিসাবে পদোন্নতি দেওয়ার ঘোষনা দেওয়া হয়। এটি মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। ২০১৩ সালের মার্চে, তিনি সিনিয়র জেনারেল পদে পদোন্নতি পান।
ইয়াঙ্গুনের কূটনীতিকরা জানান, ২০১৬ সালে যখন অং সান সু চির দল প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন, তখন মিন অং হ্লাইং একজন স্বল্পভাষী সেনা থেকে একজন রাজনীতিবিদ ও পরিচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। কিন্তু ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে, সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব বদলের কথা থাকলেও, বদলি হওয়ার পরিবর্তে আরও পাঁচ বছরের জন্য নিজের মেয়াদ বাড়িয়ে নেন মিন অং। মূলত তখন থেকেই সামরিক পরিচয়ের বাইরেও নিজেকে রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দেন মিং। সংসদে ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত আসন বাদ দেওয়ার অথবা সংবিধানের ধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে অং সান সু চি’র প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ উন্মোচনের ব্যাপারে কখনোই আগ্রহ ছিল না তার।
কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকরা আরও বলেন, অন্য দেশগুলোতে যেসব রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে, তা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন হ্লাইং। ২০১১ সালে, ক্ষমতার পালাবদলের ফলে লিবিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পরিস্থিতি দেখেও ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হননি হ্লাইং। তাই পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য শতকরা ২৫ ভাগ আসন সংরক্ষিত রাখেন।
পর্যবেক্ষকরা এক্ষেত্রে উল্লেখ করে থাকেন তার কার্যক্রম, বৌদ্ধ আশ্রমে সফর, মঠ পরিদর্শন কিংবা যাজকদের সঙ্গে বৈঠকের মতো কার্যক্রম ফেইসবুকে প্রকাশ করার কথা। তার ফলোয়ারের সংখ্যা ছিল কয়েক লাখ।
যদিও ২০১৭ সালে, রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সেই পাতাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সামরিক পদবি
২০০৮- ২০০৯ পর্যন্ত মিন অং হ্লেইং এর পদবি ছিল মেজর জেনারেল। ২০০৯ সালের শেষভাগে, পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হন তিনি। পরবর্তীতে ২০১১ সালের প্রথম দিকে, জেনারেল।
২০১২ সালের প্রথম দিকে, উপ-সিনিয়র জেনারেল এবং ২০১৩ সালে, সিনিয়র জেনারেল হন।
মানবাধিকার লঙ্ঘন
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কাউন্সিলে ইউএনএইচআরসি ( UNHRC) অভিযোগ করেন,
মিন অং হ্লাইংয়ের সৈন্যরা মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের আক্রমণ করে চলেছে এবং রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ‘পদ্ধতিগত বৈষম্য’ আরোপের এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে ।
বিশেষ করে, মিন অং হ্লাইং এর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগণ উৎখাত ও জাতিগত নির্মূলের অভিযোগ রয়েছে।
সামরিক অভিযানের কারণে ৭ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক অভিযানের মধ্যে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, গণঅগ্নিসংযোগ চালানো হয়েছে। আর এসব করা হয়েছে গণহত্যার উদ্দেশ্য থেকে।
মিন অং হ্লাইংয়ের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাসমূহ
মিয়ানমারে উত্তপ্ত জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে ফেসবুক ১৯ জন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং সংস্থাসহ অং হ্লাইং কে ফেসবুক থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজন সামরিক নেতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনের পরই ফেসবুক এ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ১৬ মে, টুইটার ও তাকে নিষিদ্ধ করে।
২০১৯ এর জুলাইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসসহ বেশ কয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান।
এছাড়াও একই বছর জাতিসংঘের তদন্তকারীরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত বাণিজ্য কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানায়।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়