ইতিহাস সমৃদ্ধ রাজশাহী জেলা

রাজশাহী জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। রাজশাহী জেলার উত্তরে নওগাঁ জেলা; দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, কুষ্টিয়া জেলা ও পদ্মা নদী; পূর্বে কুষ্টিয়া জেলা; পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। এই জেলার মোট আয়তন ২৪০৭.০১ বর্গকিলোমিটার।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এই জেলার মোট জনসংখ্যা ২৩,৭৭,৩১৪ জন।
বাংলাদেশ এর মানচিত্রে রাজশাহী জেলা
প্রশাসনিক পটভূমি
বর্তমানে আমরা যে রাজশাহী জেলার সঙ্গে পরিচিত, তার শুরু হয়েছিলো ১৮২৫ সাল থেকে।
তার আগে রাজশাহী জেলার সদরদপ্তর ছিল বর্তমান নাটোর শহর এলাকায়। ব্রিটিশরা নারদ নদের নাব্য সংকটের কারণে তৎকালীন রামপুর-বোয়ালিয়া পদ্মানদীর তীরবর্তী এলাকায় রাজশাহীর সদর ও প্রসাশনিক এলাকা স্থাপন করে।
১৭৮৬ সালে, রাজশাহীর আয়তন ছিল ১৩ হাজার বর্গমাইল অর্থাৎ পাবনা, বগুড়া, রংপুর, মালদহ ও দিনাজপুরের অনেক অংশ রাজশাহীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের জটিলতা দেখা দিলে ১৭৯৩ সালে রাজশাহীর সীমানা পরিবর্তন হয়- গঙ্গার দক্ষিণাংশ মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, ও যশােরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পরবর্তীতে ১৮১৩ সালে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হলে সীমানা আরও সংকুচিত করা হয়। রাজশাহী হতে চাপাই, রােহনপুর ও পুর্নিয়ার এবং দিনাজপুরের অংশ নিয়ে মালদহ কে পৃথক করা হয়। ১৮২১ সালে, আদমদীঘি, নােয়াকিল্লা, শেরপুর ও বগুড়া রাজশাহী হতে পৃথক হয়।
১৮২৫ সাল পর্যন্ত নাটোরই ছিল রাজশাহীর প্রধান নগর ও সদর দপ্তর যা পরবর্তীতে রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয়।
রাজশাহী শহরকে কেন্দ্র করে ১৭৭২ সালে জেলা গঠন করা হয়। ১৮৭৬ সালে, গঠিত হয় রাজশাহী পৌরসভা। ১৯৮৪ সালে, রাজশাহীর ৪ টি মহকুমাকে নিয়ে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর এবং নবাবগঞ্জ- এই চারটি স্বতন্ত্র জেলায় উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়।
রাজশাহী জেলা ৯ টি উপজেলা, ১৩ টি পৌরসভা, ৪ টি থানা, ৭১ টি ইউনিয়ন ও ১৬৭৮ টি মৌজা নিয়ে গঠিত।
নামকরণের ইতিহাস
রাজশাহী জেলার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা মতবাদ।
ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, রাজশাহী নাম টি রাণী ভবানীর দেয়া। যদিও মিঃ গ্রান্ট লিখেছেন যে, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই রাজশাহী বলা হতো এবং এই চাকলার বন্দোবস্তের কালে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনুমান করা হয়, ‘রামপুর’ এবং ‘বোয়ালিয়া’ নামক দু’টি গ্রামের সমন্বয়ে রাজশাহী শহর গড়ে উঠেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘রামপুর-বোয়ালিয়া’ নামে অভিহিত হলেও পরবর্তীতে রাজশাহী নামটিই সর্ব সাধারণের নিকট সমধিক পরিচিতি লাভ করে।
অপর দিকে রাজশাহী নামকরণ নিয়ে নিবন্ধকার কিশাের চাঁদ মিত্র লিখেছেন, “রাজশাহীতে রাজা ও জমিদারের বাস হতেই রাজশাহী নামের উৎপত্তি।” যদিও এটাও অনুমানভিত্তিক।
আবার রাজশাহীর ইতিহাস বৃত্তান্তের লেখক কালী প্রসন্ন বলেছেন, রাজশাহীতে বিদ্রোহ দমনে আলাইপুরে লস্কর খার সাথে যুদ্ধ জয় শেষে রাজা মানসিংহের নামানুসারেই রাজশাহীর নাম। এ প্রসঙ্গে ইংরেজী লেখক বলকম্যান বলেছেন, “ভাতুড়ীয়ার হিন্দু রাজা কংশ বা গণেশ গৌড় রাজ্য জয় করে মুসলমান সুলতানকে পরাজিত করে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার মতে হিন্দী শব্দ ‘রাজা’ ও ফরাসী শব্দ ‘শাহী’ এই দুই নামের সমন্বয়ে রাজশাহী নামের উৎপত্তি।”
অনেকের মতে, রাজশাহী নামকরণ নবাব মুর্শিদকুলী খান কর্তৃক করা হয়। কারণ, এই এলাকায় প্রাচীন জমিদার উদয় নারায়ণকে তিনি অত্যন্ত ভালােবাসতেন ও ‘রাজা’ উপাধি দান করেই এই সমগ্র এলাকার নাম রাজশাহী রাখেন। অবশ্য এই মতটি ই গ্রহণযােগ্য বলে একটি ঐতিহাসিক সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।
সাধারণভাবে বলা হয়, এই জেলায় বহু রাজা-জমিদারের বসবাস, এজন্য এ জেলার নাম হয়েছে রাজশাহী।
১৯৭১ সালে রাজশাহী জেলা
১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি জনপদে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার সাথে সকল স্তরের পুলিশ সদস্যগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের সংবাদে আগে থেকেই রাজশাহী পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে রাজশাহী পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশ সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে পরিখা খনন করেন এবং কয়েকটি বাংকারও তৈরি করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দৌলত খাঁনের নিকট ১৮ জন পুলিশ সদস্যের লাশ হস্তান্তর করে।
৩০ মার্চ, পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে ইপিআর সিপাহি আব্দুল মালেক শহীদ হন।
২৬ ও ৩০ মে, গোদাগাড়ী উপজেলায় পাকবাহিনীর আক্রমণে ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা নির্মমভাবে নিহত হন।
১৩ এপ্রিল, পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর ব্রিজের কাছে কলেজের অধ্যাপকসহ বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২৪ মে, পাকসেনারা বাগমারা উপজেলায় অতর্কিত আক্রমণ করে ২৫ জন লোককে হত্যা করে।
৪ আগস্ট, হাবিলদার শফিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাহিরপুরের নিকট পাকসেনাদের টহলনৌকায় আক্রমণ চালালে ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়।
চারঘাট উপজেলার নগর বাড়ি অতিক্রমরত পাকবাহিনীর সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন চারঘাটের আনসার বাহিনীর ১ জন সদস্য। সারদা, বানেশ্বর, আড়ানী ব্রিজ প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর লড়াই সংঘটিত হয়। পাকবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং শত শত লোককে নির্মম ভাবে হত্যা করে নিকটস্থ মাঠে মাটিচাপা দেয়। পাকসেনারা চারঘাটের প্রবেশমুখে বানেশ্বরে নাদের চেয়ারম্যান এবং সারদা বাজারে আনসার বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করে। ভারতে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমান কয়েকশত নিরস্ত্র মানুষকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে এবং চারঘাট বাজার পুড়িয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, ক্যাডেট কলেজ, সারদা পাইলট স্কুল, রায় সাহেবের ইটভাটা প্রভৃতি স্থানে অস্থায়ী সেনাছাউনিতে মুক্তিযোদ্ধা এবং নারীদের নির্যাতন এবং পবা উপজেলার ২৭ জন যুবককে দিয়ে পাকসেনারা একটি গণকবর খনন করায় এবং পরে তাদের সবাইকে হত্যা করে কবর দেয়। একই ইউনিয়নের বোলনপুর পুলিশ ক্যাম্পে পাকসেনারা অতর্কিত হামলা চালিয়ে ক্যাম্পের পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে একটি ইটের ভাটায় কবর দেয়। কসবা আখ ক্রয়কেন্দ্রের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী-নবাবগঞ্জ রাস্তায় টহলরত পাকবাহিনীর একটি গাড়ি অ্যামবুশ পেতে ধ্বংস করে। এতে ১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। পবা ও দুর্গাপুর উপজেলা সীমান্তে অবস্থিত কাবাসমূল নামক স্থানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে একজন পাকিস্তানি মেজর নিহত হলে বিক্ষুব্ধ পাকসেনারা গাগনবাড়ীয়া ও পালসা গ্রামের ৪৪ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এই জেলা।
রাজশাহী জেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ৬ টি গণকবর, ২ টি বধ্যভূমি এবং ৪ টি ভাস্কর্য রয়েছে।
চিত্রঃ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্থাপিত ভাস্কর্য ‘সাবাস বাংলাদেশ’
দর্শনীয় স্থান
যশোর জেলার চিত্তাকর্ষক স্থান ও স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পুঠিয়া রাজবাড়ি, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, জিয়া পার্ক, পদ্মা গার্ডেন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা, পানসিপাড়া রাজবাড়ী কুঠি, বাঘা মসজিদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজা কংস নারায়ণের মন্দির, সাবাস বাংলাদেশ (ভাস্কর্য), গোয়ালকান্দি জমিদার বাড়ি, তামলি রাজার বাড়ি এবং হাজারদুয়ারি জমিদার বাড়ি ইত্যাদি।
চিত্রঃ বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর
চিত্রঃ পুঠিয়া রাজবাড়ী
প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব
রাজশাহী জেলার কৃতি ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, শহীদ এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান; প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী; অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়; রাণী ভবানী; মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবী; কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন; যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী খাজা এম, এ মজিদ এবং কবি রজনীকান্ত সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
তথ্যসূত্রঃ
১. বাংলাপিডিয়া
২. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়