ইতিহাস সমৃদ্ধ পাবনা জেলা

পাবনা জেলা বাংলাদেশের মধ্যভাগের রাজশাহী বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল। এই জেলার মোট আয়তন ২,৩৭১.৫০ বর্গ কি.মি.। পাবনা জেলার উত্তরে সিরাজগঞ্জ জেলা আর দক্ষিণে পদ্মা নদী এই জেলা টি কে রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়া জেলা হতে পৃথক করেছে। এর পূর্ব প্রান্ত দিয়ে যমুনা নদী বয়ে গেছে এবং পশ্চিমে নাটোর জেলা অবস্থিত। পাবনার আমিনপুর থানার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে এসে পদ্মা ও যমুনা নদী পরস্পর মিলিত হয়েছে। পাবনা হচ্ছে একমাত্র জেলা যেখানে পদ্মা এবং যমুনা একই সাথে বিরাজমান।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এই জেলার মোট জনসংখ্যা ২৮,৬০,৫৪০ জন।
চিত্রঃ বাংলাদেশ এর মানচিত্রে পাবনা জেলা
প্রশাসনিক পটভূমি
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর ‘পাবনা’ একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
সাবেক পাবনা (সিরাজগঞ্জ জেলাসহ) জেলা রূপে গঠিত এলাকা টি প্রাচীন যুগে পূর্ব ভারতের বঙ্গ ও পুণ্ড্রবর্ধন জনপদের অংশ ছিল।
১৭২৭-১৭৩৯ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা তৎকালীন সুবেদার নবাব সুজা উদ্দিনের শাসনাধীনে ছিলো।
১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে, পাবনা জেলার বেশির ভাগ অংশ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজশাহী জেলার ৫টি থানা ও যশোর জেলার ৩টি থানা নিয়ে সর্ব প্রথম পাবনা জেলা গঠিত হয়।
১৭ অক্টোবর ১৮৪৮খ্রিস্টাব্দে, জেলার পূর্ব সীমা নির্দিষ্ট করা হয় যমুনা নদী।
১২ জানুয়ারি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে, সিরাজগঞ্জ থানাকে মোমেনশাহী জেলা থেকে বাদ দিয়ে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে মহকুমায় উন্নীত করে পাবনা ভুক্ত করা হয়।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে, কোম্পানি শাসনের অবসানের পর, এ জেলা টি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী মহারাণী ডিক্টোরিয়ার শাসনাধীনে চলে যায়।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে, পাবনায় মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয়।
১৯৮৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত পাবনা সদর মহকুমা এবং মহকুমা সিরাজগঞ্জ নিয়ে পাবনা জেলা গঠিত ছিল।
১৯৮৪ সালে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ ২টি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
পাবনা জেলা ৯ টি উপজেলা, ১০ টি পৌরসভা, ১১ টি থানা, ৭৪ টি ইউনিয়ন ও ১,৫৪৯ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত।
নামকরণের ইতিহাস
পাবনা’ নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের কিংবদন্তি। রাধারমন সাহা তার ‘পাবনা জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থে পদ্মার অববাহিকা ‘পাবনী’ থেকে পাবনা’র নামকরণ হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
অপর একটি সূত্রে জানা যায়, ‘পাবন’ বা ‘পাবনা’ নামের একজন দস্যুর আড্ডাস্থলই এক সময় ‘পাবনা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
অপরদিকে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘পাবনা’ নাম এসেছে ‘পদুম্বা’ থেকে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রামপাল হ্নতরাজ্য বরেন্দ্র কৈবর্ত শাসকদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য ১৪ জন সাহায্যকারীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তাদেরই একজন ছিলেন পদুম্বার সোম নামক জনৈক সামন্ত। কালক্রমে পদুম্বাই স্বরসঙ্গতি রক্ষা করতে গিয়ে বা শব্দগত অন্য ব্যুৎপত্তি হয়ে পাবনা হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক কানিংহাম অনুমান করেন, প্রাচীন রাজ্য ‘পুন্ড্র’ বা ‘পুন্ড্রবর্ধন’ এর নাম থেকে ‘পাবনা’ নামের উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে।
অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, পৌন্ড্রবর্ধন থেকে ‘পাবনা’ নামের উৎপত্তি হয়েছে। পৌন্ড্রবর্ধনের বহু জনপদ গঙ্গার উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল। চলতি ভাষায় পুণ্ড্রবর্ধন বা পৌন্ড্রবর্ধন, পোনবর্ধন বা পোবাবর্ধনরূপে উচ্চারিত হতে হতে ‘পাবনা’ হয়েছে।
১৯৭১ এ পাবনা জেলা
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেয় পাবনার জনগন। পাবনা জেলা ও থানায় থানায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
২৩ মার্চ, পাবনার টাউন হলে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। জেলা প্রশাসক জনাব এম নূরুল কাদের খান মুক্তিকামী জনতার জন্য পুলিশ লাইনের অস্ত্র ভাণ্ডার খুলে দিয়ে পাক বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হবার আহবান জানান।
২৫শে মার্চ রাতে, পাবনায় পাঠানো প্রায় ১৫০ জন পাক হানাদার বাহিনীর সকলেই নিহত হয়।
২৬ মার্চ রাতে, পাক সেনারা বিসিক শিল্পনগরীতে ঘাঁটি করে এবং টেলিগ্রাফ অফিস, সার্কিট হাউজ, স্টেডিয়াম, ডাকবাংলো দখলে নেওয়ার পর ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় পুলিশ লাইন আক্রমন করে তারা। ব্যারাকের পুলিশ সদস্যরা এবং জেল পুলিশ মিলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহরের মুক্তিকামী জনতার সাথে প্রতিরোধে অংশ নেয় চরাঞ্চল এবং গ্রাম অঞ্চল থেকে আশা হাজার হাজার মানুষ। পাবনায় প্রতিরোধযুদ্ধ সংগঠিত হয় মোট ১৭টি স্থানে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাবনা পুলিশ লাইন, টেলিফোন একচেঞ্জ, ময়লাগাড়ী, সার্কিট হাউস সংলগ্ন কাঠের ব্রীজ, বিসিক, মাধপুর বটতলা, ঈশ্বরদী বিমান বন্দর, দাশুড়িয়া তেঁতুল তলা, মুলাডুলি এবং মালিগাছা।
ফলশ্রুতিতে টেলিগ্রাফ অফিসসহ বিভিন্ন স্থানের প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ২৮ মার্চ পাকসেনারা পালিয়ে চলে যায় রাজশাহী।
২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা ছিল স্বাধীন। ১৪ দিন পাবনা মুক্ত থাকার পর ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকহানাদার বাহিনী পুনরায় পাবনায় ঢোকার মুখে নগরবাড়ী ঘাটে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র জনতার উপর জল, স্থল ও আকাশ থেকে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পাবনায় পিছু হটে আসে। কিছু মুক্তিযোদ্ধা পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার ডাব বাগান নামক স্থানে অবস্থান নেয়। কিন্তু সেখানে আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া পাকহানাদার বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। পাকহানাদার বাহিনীর ১৩ জন সদস্য নিহত হয়। পরবর্তীতে ঐ যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ঐ স্থানের নামকরণ করা হয়, “শহীদনগর”।
বাংলাদেশের মানচিত্রে সম্মুখ সমরে প্রথম শত্র্রু অবমুক্ত জনপদ হওয়ার দূর্লভ গৌরব অর্জন করে পাবনা।
৪ এপ্রিল, আনুষ্ঠানিকভাবে কোর্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশর পতাকা উত্তোলিত হয়। অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তথ্য প্রবাহের সুযোগ না থাকায় এবং ১৭ তারিখ পর্যন্ত পাকসেনারা দখলরত থাকায় পাবনা শত্রুমুক্ত হয় ১৮ মার্চ।
চিত্রঃ শহীদ নগর
দর্শনীয় স্থান
পাবনা জেলার চিত্তাকর্ষক স্থান ও স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চলন বিল, লালন শাহ্ সেতু, গাজনার বিল, পাকশীস্থ হার্ডিঞ্জ ব্রীজ, শাহী মসজিদ (চাটমোহর), শাহী মসজিদ (ভাড়ারা), শ্রী শ্রী অনুকূল চন্দ্র ঠাকুরের আশ্রম, জোড় বাংলা মন্দির, তাড়াশ ভবন, ক্ষেতুপাড়া জমিদার বাড়ি, পাকশী রিসোর্ট, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলস, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, কাঞ্চন পার্ক, খয়রান ব্রীজ, প্রশান্তি ভুবন বিনোদন পার্ক, ঈশ্বরদী রেল জংশন, শিতলাই জমিদার বাড়ি ও বড়াল ব্রীজ ইত্যাদি।
চিত্রঃ চলন বিল
চিত্রঃ গাজনার বিল
কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব
পাবনা জেলা অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জন্মস্থান হিসেবে সকলের নিকট অত্যাধিক পরিচিত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, বীর উত্তম আবদুল করিম খন্দকার; কিংবদন্তি চিত্রনায়িকা সুচিত্রা সেন; রাজেন্দ্র লাহিড়ী; অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা সাইফুল আজম; সংগীত শিল্পী বাপ্পা মজুমদার; কবি ও ঔপন্যাসিক বন্দে আলী মিয়া; অগ্নিযুগের বিপ্লবী মোহিতমোহন মৈত্র; সাবেক প্রতিমন্ত্রী ড. মির্জা আব্দুল জলিল; কবি ও গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার; সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এবং অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী, বৃন্দাবন দাস ও আজিজুল হাকিম প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
তথ্যসুত্রঃ
১. বাংলাপিডিয়া
২. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বনায়ন
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়