যশোর জেলার ইতিহাস

যশোর জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। প্রশাসনিক কাঠামোর দিক থেকে যশোর বাংলাদেশের ১৩তম বৃহত্তম জেলা। এই জেলার মোট আয়তন ২,৬০৬.৯৪ বর্গ কি.মি.। যশোর জেলার উত্তরে ঝিনাইদহ জেলা ও মাগুরা জেলা, দক্ষিণ পূর্বে সাতক্ষীরা জেলা, দক্ষিণে খুলনা জেলা, পশ্চিমে ভারত এবং পূর্বে নড়াইল জেলা অবস্থিত।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এই জেলার মোট জনসংখ্যা ২৭,৬৪,৫৪৭ জন।
চিত্রঃ বাংলাদেশ এর মানচিত্রে যশোর জেলা
প্রশাসনিক পটভূমি
যশোর একটি অত্যন্ত প্রাচীন জনপদ। প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন জেলা। টলেমির মানচিত্রে বিস্তারিত ভাবে গঙ্গা নদীর পলল অবক্ষেপণে সৃষ্ট যশোর জেলার সবচেয়ে পুরাতন বিবরণ পাওয়া যায়৷ ধারনা করা হয়ে থাকে, ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পীর খান জাহান আলীসহ বারজন আউলিয়া যশোরের মুড়লীতে ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেন। আনুমানিক ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তৎকালীন সময়ে যশোর-খুলনা-বনগাঁ এবং কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের অংশ বিশেষ যশোর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে যশোর নাটোরের রাণী ভবানীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রায় ২৪০ বছর আগে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে, যশোর একটি পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জেলা।
যশোর জেলা ৮ টি উপজেলা, ৮ টি পৌরসভা, ৯ টি থানা, ৯৩ টি ইউনিয়ন ও ১০৩৬ টি মৌজা নিয়ে গঠিত।
নামকরণের ইতিহাস
খেজুরের গুড়ের জন্যে প্রসিদ্ধ এই যশোর জেলার নামকরণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়। আরবি ‘জসর’ থেকে যশোর শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করেন অনেকেই। আরবি জসর শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘সাকো’। এককালে যশোরের সর্বত্র নদীনালায় পরিপূর্ণ ছিল বলে নদী বা খালের ওপর সাঁকো বানানো হতো। অনুমান করা হয় খানজাহান আলী বাঁশের সাকো নির্মাণ করে ভৈরব নদী পার হয়ে মুড়লীতে আগমন করেন বলে বাঁশের সাকো থেকে যশোর নামের উৎপত্তি। যদিও খানজাহান আলী আসার আগে থেকেই ‘যশোর’ নামটি প্রচলিত বলে অভিমত দেওয়ায় এই মতে সমর্থকদের সংখ্যা খুবই কম।
কেউ কেউ বলেছেন, আরবি শব্দ ‘জেসিনরে’ থেকে যশোর নামের উৎপত্তি যার অর্থ ‘সাঁকো’।
বঙ্গের শেষ পাঠান নৃপতি ‘দায়ুদ শাহ’ মোঘলদের কাছে পরাজিত হয়ে পালানোর সময় রাজধানী গৌড় ও তাণ্ডার অধিকাংশ রাজকীয় ধনরত্ন বিক্রমাদিত্যের হাতে সমর্পণ করেন। কেউ কেউ এমন অনুমান করেন যে, নতুন প্রতিষ্ঠিত যশোর নগরী এভাবে গৌড়ের যশ: হরণ করে বলেই এর নাম হয়েছিল- যশোহর।
আবার কেউ বলেন যে, গৌড়ের সাথে তুলনা না করেই কোন ব্যক্তি এ রাজ্য ‘অত্যাধিক যশস্বী’-এই অর্থে ‘যশোহর’ নাম দিয়েছিলেন। এই যশোর শব্দ ‘যশোহর’ শব্দের ই অপভ্রংশ।
আবার অনেকের মতে, রাজা প্রতাপদিত্যের পতনের পর চাঁচড়ার রাজাদের যশোরের রাজা বলা হত। কারণ তারা যশোর রাজ প্রতাপাদিত্যের সম্পত্তির একাংশ পুরস্কার স্বরূপ অর্জন করেছিলেন।
১৯৭১ এ যশোর জেলা
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক আর্মির বর্বরতা শুরু হলে নিরস্ত্র বাঙালির সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাবার প্রধান পথ হয়ে ওঠে যশোর রোড।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সাবেক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এ্যাডভোকেট মশিউর রহমান কে বন্দী ও পরবর্তীতে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
২৭ মার্চ হানাদার বাহিনীর গুলিতে অভয়নগরে নওয়াপাড়া রেলস্টেশনের অফিস কক্ষে রেলওয়ের কয়েকজন স্টাফ এবং আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক নজিবর রহমান সহ আরও ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২৯ মার্চ যশোর সেনানিবাসের ৩০০ বাঙালি সৈনিক শহীদ হন এবং ৩০ মার্চ মুক্তিযোদ্ধারা ৫০ জন পাকসেনাকে হত্যা করে।
৫ সেপ্টেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ঝিকরগাছা উপজেলার গোয়ালহাটি গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত এক যুদ্ধে শহীদ হন। পাকবাহিনী বেনাপোল সীমান্তের পূর্বে ৩টিগ্রাম ভস্মীভূত করে দেয়।এছাড়াও বাঘারপাড়া, শার্শা, ঝিকরগাছা এবং চৌগাছা উপজেলায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক পাকবাহিনী এবং রাজাকার নিহত হয়।
৬ ডিসেম্বর সকালে ও দুপুরে দুই দফায় প্রচণ্ড লড়াই হয় ভারতীয় ৯ম পদাতিক ও ৪র্থ মাউন্টেন ডিভিশনের সঙ্গে পাকিস্তানি ৯ম ডিভিশনের। সুরক্ষিত পাক দুর্গ বলে খ্যাত যশোর ক্যান্টনমেন্টে পর্যাপ্ত সৈন্য না থাকায় পাকিস্তানি সেনারা হতোদ্যম হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে থাকে।
৭ ডিসেম্বর যশোর জেলা শত্রুমুক্ত হয়। যা ছিলো দেশের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা।
চিত্রঃ ১৯৭১ এ যশোর রোড
যশোর জেলার নদনদী
যশোর জেলার উল্লেখযোগ্য নদী সমূহ হল- কপোতাক্ষ, ভৈরব, চিত্রা, মুক্তেশ্বরী ও হরিহর নদী ইত্যাদি।
দর্শনীয় স্থান
যশোর জেলার চিত্তাকর্ষক স্থান ও স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সদর উপজেলার জেসগার্ডেন পার্ক, মনিহার সিনেমা হল, ইমামবাড়ি, কেশবপুরের ভরতের দেউল, খাঞ্জালির দীঘি, সাগরদাড়ি গ্রামের মধুপল্লী, মীর্জানগর হাম্মামখানা, অভয়নগরের খানজাহান আলী জামে মসজিদ, শ্রীধরপুর জমিদার বাড়ি, রূপসনাতন ধাম, চাঁচড়া জমিদার বাড়ি, ফুলের হাট গদখালি, বেনাপোল স্থল বন্দর, কালেক্টরেট পার্ক, লালদীঘির পাড়, ঝাঁপা ভাসমান সেতু ও বৈদ্যনথ তলা মন্দির ইত্যাদি।
চিত্রঃ বেনাপোল স্থল বন্দর
চিত্রঃ ভরত রাজার দেউল
বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ
যশোর জেলার নাম বললে প্রথমেই যেই ব্যক্তির কথা মাথায় আসে তিনি হচ্ছেন প্রখ্যাত কবি এবং নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এছাড়াও যশোর জেলা প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান; সাহিত্যিক ড. মোহাম্মদ লুৎফর রহমান; অগ্নিযুগের শহীদ বিপ্লবী বাঘা যতীন; বিপ্লবী এবং সংগ্রামী কৃষক নেতা ইলা মিত্র; রাজা প্রতাপাদিত্য; তেভাগা আন্দোলনের নেতা কমরেড অমল সেন; জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র; এবং অভিনেত্রী সুচন্দা, ববিতা, চম্পা, শাবনূর এর জন্মস্থান হিসেবে অধিক পরিচিত।
চিত্রঃ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
তথ্যসূত্রঃ
১. বাংলাপিডিয়া
২. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়