সমুদ্রের যমদূতঃ ভাইকিং!

ভাইকিং! শব্দটি অনেকের কাছেই পরিচিত অনেকেই আবার শুনছেন প্রথমবারের মত। এই জানা-অজানার মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকা শব্দটিই এককালে ইউরোপ,আমেরিকা, রাশিয়ান অঞ্চলের মানুষদের তঠস্থ করে রেখেছিল।
এরা মূলত ছিল জলদস্যু, যাদের ইতিহাস ভাইকিং নামে স্মরণ করে। শব্দটির উৎপত্তি স্ক্যান্ডেনিভিয়ান শব্দ ‘বিকা’ থেকে, যার অর্থ (উপসাগর বা খাদ)। স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের একটি বিশাল সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য মাতৃভূমি ত্যাগ করে সমুদ্র তীরবর্তি অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। সমুদ্র সৈকতে বসতি স্থাপনকারী, জীবিকার তাগিদে অনবরতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত এসব মানুষরাই ভাইকিং নামে পরিচিত ছিলো। স্ক্যান্ডেনিভিয়া তথা বর্তমান নরওয়ে,সুইডেন,ডেনমার্ক এসকল অঞ্চলে তাদের আধিপত্য বেশি ছিল।

এ সকল অঞ্চলের মাটি ছিল রুক্ষ ও অনুর্বর, এ ছাড়াও ছিল প্রচন্ড শীতের প্রকোপ । শীতকালে নিজ ও পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে তারা জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে বেড়িয়ে পড়ে লুটতরাজ চালিয়ে আসত। অনেকটা বাঁচার তাগিদেই প্রতি বছর জাহাজে চেপে বিভিন্ন দেশে অভিযানে বের হতো তারা। লুটের মাল যত বেশী হবে, তত আরামে কাটবে শীতের মৌসুম। তাই লুটপাট চালানোর ব্যাপারে তারা ছিলো অসম্ভব নির্মম আর অসভ্য।
জাহাজ নির্মাণশৈলি তে তারা হয়ে উঠেছিল ইতিহাস বিখ্যাত। কোন জাহাজ কতটা শক্তিশালী ভাবে তৈরি করতে হবে,তা কতজন মানুষ বহন করতে পারবে পরিস্থিতি তাদের সে সকল বিষয়ে পরিপক্ক করে তুলেছিল। প্রতিটি অভিযান শেষে নিরাপদে ফিরে আসা নাবিকদের বর্ণনা অনুযায়ী তারা সামুদ্রিক নকশা তৈরি করত। সাধারনত দুই ধরনের জাহাজ বানাত তারা , তার মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিলো ‘ল্যাংস্কিপ’ যেটা ছিলো আদতে যুদ্ধ জাহাজ। এই জাহাজগুলোতে চেপে তারা বিভিন্ন দেশে হামলা করত।

তাদের আক্রমণের সর্বপ্রাচীন রেকর্ড পাওয়া যায় ৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডে। এছাড়াও তারা ফ্রান্স,আয়ারল্যান্ড,স্কটল্যান্ড,রাশিয়া সহ এসকল অঞ্চলে ৭০০ থেকে ১১০০ শতক পর্যন্ত তান্ডব অব্যাহত রাখে। ধারণা করা হয় তারাই বোধহয় প্রথম ইউরোপিয়ান প্রাচীন অধিবাসী যারা আমেরিকা আবিস্কার করেছিল।
তাদের আক্রমণের সর্বপ্রাচীন রেকর্ড পাওয়া যায় ৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডে। এছাড়াও তারা ফ্রান্স,আয়ারল্যান্ড,স্কটল্যান্ড,রাশিয়া সহ এসকল অঞ্চলে ৭০০ থেকে ১১০০ শতক পর্যন্ত তান্ডব অব্যাহত রাখে। ধারণা করা হয় তারাই বোধহয় প্রথম ইউরোপিয়ান প্রাচীন অধিবাসী যারা আমেরিকা আবিস্কার করেছিল।
টিথ ফাইলিং ছিল তাদের সমাজের আভিজাত্যের প্রতীক। সাম্প্রতিক কালে নৃতাত্ত্বিক রা ৫৫ টি ভাইকিং কঙ্কাল খুজে পান যাদের প্রত্যেকেরই টিথ ফাইলিং করা ছিল। এছাড়াও মৃতদের নখ কেটে রাখাও তাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত ছিল।

ভাইকিংরা কোন নির্দিষ্ট বংশ বা ধর্মের মতাবলম্বী ছিলো না। শুরুর দিকের দুই শতাব্দী ভাইকিংরা ছিলেন প্যাগান অর্থাৎ বহু দেব-দেবীর উপাসক । মার্ভেল সিরিজের কল্যাণে আমরা আজকাল যে থর,ওডিন, লোকীদের চিনি তারা আদতে ভাইকিংদের এসকল উপাস্য দেবতা ছিল। ধীরে ধীরে এসকল ভাইকিংরাও আশ পাশের খ্রিস্টান দেশগুলোর প্রভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পূর্বে চার্চ ও আশ্রমের উপর হামলা চালানো ছিল তাঁদের কাছে অতি সাধারণ ঘটনা। তাই ইউরোপিয়ানরা তাদের অসভ্য ঘৃণাতুল্য ভাবত। তবে সাধারণ ইউরোপীয়ানদের তুলনায় তাদের পরিস্কার,পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস বেশ ভালো ছিল। যেখানে অধিকাংশ ইউরোপীয়ানরা গোসল এড়িয়ে চলত সেখানে তারা এসকল দিকে বেশ পরিপাটি ছিল।
আস্তে আস্তে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার দরুন ভাইকিংরা ক্রমশ অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে মিশে যেতে থাকে এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে দস্যুবৃত্তির আদতে আর কোন প্রয়োজন রয় নি তাদের কাছে । ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে ভাইকিংদের একটি গোষ্ঠী রাজ্যও স্থাপন করে। তারা নরম্যান নামে পরিচিত হতে থাকে। এভাবেই আস্তে আস্তে এগারশ শতকের শেষ দিকে অস্তিত্ব খুয়াতে থাকে ভাইকিং রা। এতদসত্ত্বেও ইউরোপীয়ানরা এদের নিজেদের জাতিরূপে মেনে নিতে পারে নি, কারণ তারা একটি বিদেশী জাতি হিসেবে এসেছিল এবং তাদের কর্মকান্ড ছিল বর্বরোচিত।

কিন্তু এতকাল পড়েও রাশিয়ান, উত্তর আয়ারল্যান্ডের কিছু জাতি, এবং স্পেনের এক বৃহদাংশ নিজেদের ভাইকিংদের উত্তরসূরী ভেবে থাকে। এবং প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন ভাবে তারা তাদের পূর্বপুরুষ দের নামে বিভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে।
মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ খান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরো পড়ুন; মোঙ্গলদের পতনের ইতিহাসhttps://cutt.ly/yjbuYeg