
বাঙ্গালি রাজাদের ইতিহাসে প্রথম সার্বভৌম রাজা হিসেবে যাকে মানা হয়, তিনি রাজা শশাঙ্ক। বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান দখল করে থাকা এই ব্যক্তি বাঙ্গালির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে আর্যদের ধারনা। ইতিহাসবিদদের মতে, আনুমানিক ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলায় রাজত্ব করেন।
রোহতাসগড়ে প্রাপ্ত সীলের ছাঁচ, বাণভট্টের সমসাময়িক সাহিত্য উপকরণ, চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাঙ এর বিবরণ এবং বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ থেকে শশাঙ্কের ইতিহাস কিছুটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়। যদিও অনেক কিছুই এখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে।
প্রাথমিক জীবন
শশাঙ্কের প্রাথমিক জীবন, বংশ ও শৈশব সম্পর্কে খুব বেশি জানা সম্ভব হয়নি। অনেকেই মনে করেন, শশাঙ্ক গুপ্ত রাজপরিবারের সদস্য এবং তার পূর্বনাম ‘নরেন্দ্রগুপ্ত’।
কিন্তু অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এটি একটি ভিত্তিহীন তথ্য। প্রাচীন রোহিতাশ্বের বা রোহতাসগড়ের পাহাড়ের গায়ে ‘শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক’ নামটি খোদাই করা আছে বলে অনেকেই মনে করেন, শশাঙ্ক ছিলেন কেবল একজন মহাসামন্ত। এক্ষেত্রে একটি দ্বিতীয় মত প্রতিষ্ঠা হয়। যারা মনে করে, শশাঙ্ক রোহতাসগড় রাজ্যের সামন্ত রাজা ছিলেন। যদিও ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষদিকে গুপ্তরাজ মহাসেন গুপ্ত মগধ ও গৌড়ের অধিপতি ছিলেন। সুতরাং শশাঙ্ক এই মহাসেন গুপ্তের অধীনে গৌড়ের মহাসামন্ত ছিলেন, এটিই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মত।
শাসনামল (৫৯০ – ৬২৫)
আনুমানিক ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে, গুপ্তশাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন রাজা শশাঙ্ক। তাঁর রাজ্যের রাজধানীর নাম দিয়েছিলেন ‘কর্ণসুবর্ণ’। রাজ্য টি নিজের অধীনে নেওয়ার পরই তিনি রাজ্য পরিচালনায় মনোনিবেশ করেন।
চিত্রঃ শশাঙ্কের রাজধানী ‘কর্ণসুবর্ণ’
রাজা হওয়ার পর পরই তার ক্ষমতা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এর রেশ ধরেই তিনি প্রথমে দক্ষিণের দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর), উৎকল ও কোঙ্গোদ রাজ্য জয় করেন। এই সময়ে দক্ষিণবঙ্গের রাজাও শশাঙ্কের কাছে অধিনতা স্বীকার করে নেয় বলে জানা যায়।
চিত্রঃ শশাঙ্কের সময়কার মুদ্রা
শক্তিসঙ্গম তন্ত্র গ্রন্থের ৭ম পটল ‘সটপঞ্চষদ্দেশবিভাগ’ এ বলা হয়েছে যে, গৌড়ের সীমানা বঙ্গদেশ হতে ভুবনেশ (উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এটি অসম্ভব নয় যে, লেখক শশাঙ্কের রাজ্যসীমা, যা উড়িষ্যার একটি অংশকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল, চিন্তা করেই গৌড় দেশের বিস্তৃতির বর্ণনা দিয়েছেন। এমন সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এর আগে কোনো রাজা করতে পেরেছে বলে জানা যায়নি।
চিত্রঃ শশাঙ্কের সময়কার রৌপ্যমুদ্রা
কিন্তু এত কিছুর পরেও থেমে থাকেন নি তিনি। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মৌখরীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে ‘মগধ’ মুক্ত করা। এই সময়ে মৌখরীর রাজা ছিলেন ‘গ্রহবর্মণ’। তিনি থানেশ্বরের রাজা পুষ্যভূতি রাজবংশের রাজা ‘প্রভাকরবর্মণ’ এর কন্যা ‘রাজ্যশ্রী’ কে বিয়ে করেন। যার ফলে উভয় রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠে। বংশাক্রমে মালব রাজ্যের সাথে পুষ্যভূতি রাজবংশের শত্রুতা থাকায় মালব-রাজ ‘দেবগুপ্ত’, পুষ্যভূতি রাজবংশের শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং রাজশক্তি বৃদ্ধির জন্য শশাঙ্কের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হন।
অপরদিকে কামরূপের রাজা ‘ভাস্করবর্মণ’ শশাঙ্কের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত ছিলেন বিধায় ‘ভাস্করবর্মণ’, পুষ্যভূতি রাজবংশের পক্ষে যোগ দেন। এরপর এই রাজ-শক্তিদ্বয়ের ভিতর যুদ্ধ শুরু হয়। যদিও ঠিক কি সূত্র ধরে এই যুদ্ধের শুরু হয়েছিল, তার কোনো হদিস পাওয়া যায় নি।
হর্ষবর্ধনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব
‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থ অনুযায়ী, ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে মালবের রাজা ‘গ্রহবর্মা’ কে যুদ্ধে হারিয়ে রানী ‘রাজ্যশ্রী’ কে বন্দি করেন। এই ঘটনার পর, ‘রাজ্যবর্ধন’ ছোট ভাই হর্ষবর্ধনের উপর রাজ্যসভার ভার ছেড়ে দিয়ে বোন কে উদ্ধার করতে রওনা হয়। এবং পথিমধ্যে মালব রাজাকে পরাজিত করেন। কিন্তু কান্যকুঞ্জে পৌঁছানোর আগেই তিনি শশাঙ্কের হাতে পরাজিত হন ও মৃত্যুবরণ করেন।
বাণভট্ট, চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাঙ এবং আরো অনেক ইতিহাসবিদদের মতে, রাজ্যবর্ধন গৌড়ের রাজার মিথ্যা আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে নিরস্ত্র ও একাকী অবস্থায় শত্রুশিবিরে নিহত হন।
রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভাই ‘হর্ষবর্ধন’ তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বোন ‘রাজ্যশ্রী’ কে উদ্ধার এবং শশাঙ্ককে শাস্তি দিতে অগ্রসর হন। এই সময় এর সাথে যোগ দেন কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মন। কিন্তু শশাঙ্ক ভাস্করবর্মণ ও হর্ষবর্ধনের সেনাবহিনী দ্বারা আক্রমণ এড়িয়ে, কৌশলের সাথে ‘কনৌজ’ ত্যাগ করেন।
বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ সূত্রে জানা যায়, বোন রাজ্যশ্রী কে উদ্ধার করে তার অনুমতি নিয়ে কান্যকুঞ্জর সিংহাসনে আরোহণ করেন ‘হর্ষবর্ধন’।

চিত্রঃ রাজা ‘হর্ষবর্ধন’
পরবর্তীতে শশাঙ্ক উত্তর উড়িষ্যা এবং বাংলা ব-দ্বীপাঞ্চলের দক্ষিণাংশও তার রাজত্বের অংশ করে নেন।
বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ এ পুণ্ড্রবর্ধনের যুদ্ধে হর্ষের হাতে শশাঙ্কের পরাজয়ের কাহিনী এবং তাঁর ১৭ বছরের রাজত্বকাল সম্পর্কে বর্ণনা থাকলেও তা সমসাময়িক অপর কোন উৎস দ্বারা সমর্থিত নয়। তাছাড়া সম্প্রতি দক্ষিণ মেদিনীপুর থেকে আবিষ্কৃত শশাঙ্কের শিলালিপিতে দণ্ডভুক্তি জনপদের অস্তিত্বের উল্লেখ রয়েছে, যা মেদিনীপুর ও উড়িষ্যার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ছিল।
মৃত্যু
হিউয়েন সাঙ এর মতে, ‘শশাঙ্ককে শায়েস্তা করার জন্যই বোধিসত্ত্বের নির্দেশে হর্ষের জন্ম হয়েছে’।
‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ মতে, শশাঙ্কের রাজত্বকাল মাত্র ১৭ বছর। কিন্তু হিউয়েন সাঙ এর তথ্য থেকেই এই মতামত টি ভুল প্রমাণিত হয়। তার তথ্যানুযায়ী, ৬৩৭ সালের দিকেও শশাঙ্ক রাজত্ব করেছেন এবং তার কিছুকাল পরেই মৃত্যুবরণ করেন। অনেকেই মনে করেন, বুদ্ধমূর্তি নষ্ট করায় তার শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং সে কারণেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যদিও এ কথারও কোনো সত্যতা নেই।
ব্যক্তিগত জীবন
শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক এবং শৈব ধর্মের প্রতি একান্ত অনুরাগী। বানভট্ট এবং হিউয়েন সাঙ এর মতে, শশাঙ্ক বৌদ্ধ-বিদ্বেষী ছিলেন। কিন্তু নালন্দায় অবস্থিত বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের (নালন্দা মহাবিহার) উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং শশাঙ্কের রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণের কাছেই ‘রক্তমৃত্তিকা’, ‘মহাবিহার’ সহ অনেক গুলো বৌদ্ধ মঠের অস্তিত্ব থেকে হিউয়েন সাংয়ের দেয়া তথ্য সঠিক নয় বলে মনে হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, তৎকালীন সময়ের তিনটি লিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, শশাঙ্ক বেশ ভালো রাজা ছিলেন। বাণভট্টের মতো চরিত লেখক কিংবা হিউয়েন সাঙ এর মতো সুহৃদ থাকলে হয়তো হর্ষবর্ধনের মতো তার খ্যাতিও চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায়, নিজ দেশে অখ্যাত ও অজ্ঞাত শত্রুর কলঙ্ক-কালিমাই তাকে জগতে কুখ্যাতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
উত্তরসূরী
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তার সন্তান মানব আট মাস ধরে গৌড় রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর ই ‘গৌড়’, ‘হর্ষবর্ধন’ ও কামরূপের ‘ভাস্করবর্মন’ এর অধীনস্থ হয়। এমনকি ‘ভাস্করবর্মন’ শশাঙ্কের রাজ্যের রাজধানী ‘কর্ণসুবর্ণ’ ও দখল করে নেয়।
তথ্যসূত্র:
১.মজুমদার, রমেশ্চন্দ্র, বাংলা দেশের ইতিহাস (প্রাচীন যুগ), জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাব্লিশার্স (১৯৯৮), পৃষ্ঠা নং- ৩১-৩৭
২.পৃথিবীর ইতিহাস (দ্বিতীয় খণ্ড)। শ্রীদুর্গাদাস লাহিড়ী। দ্বিতীয় সংস্করণ। ১৩২১ বঙ্গাব্দ।
৩.বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড, কায়স্থ-কাণ্ডের প্রথমাংশ)। ১৩২১ বঙ্গাব্দ।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়