মোঙ্গলদের পতনের ইতিহাস

সামান্য এক যাযাবর গোষ্ঠী থেকে ঝড়ের মত আবিস্কার হওয়া মোঙ্গল জাতি, ইতিহাসকে একেবারে দুমড়ে, মুচড়ে, ভেঙে নিজের মত করে লিখেই যাচ্ছিল। ধবংস করে যাচ্ছিল শত বৎসরের তিলে তিলে গড়ে তোলা সভ্যতা, ভেঙে যাচ্ছিল দূর্গের পর দূর্গ, পদানত করে যাচ্ছিল একের পর এক সাম্রাজ্য।ইতিহাসকে রক্ত দিয়ে স্নান শেষ করানোর পরই যেন নিজ কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করল! যেমনি ঝড়ের ন্যায় এসেছিল এ জাতি তেমনি মোমবাতির মত ধপ করে নিভেও গেল।

সকল ঘটনার অবতারণা ঘটে সেই ১২’শ শতাব্দীর শুরুতে। যখন ১২০৬ সালে ইতিহাস বিখ্যাত চেঙ্গিস খান মঙ্গোল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীকে জানান দেন মোঙ্গলরা আসছে। চেঙ্গিস খান বিশ্বাসী ছিলেন টেংরি ধর্মে। তার বিশ্বাস অনুযায়ী প্রভু টেংরি তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সমস্ত পৃথিবী তার পদানত করতে এবং যারা তার বিরোধীতা করবে তারা স্বয়ং টেংরির বিরোধীতা করছে। এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী চেঙ্গিস আগামী ২১ বছরে খেলে গেলেন রক্তের হলি খেলা। ধবংস করে যেতে লাগলেন একের পর সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস খানের জীবদ্দশাতেই সাম্রাজ্যের পরিমাণ এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে তা একক কারো পক্ষে শাসন করা সম্ভব ছিলো না। তাই তিনি তার সাম্রাজ্যকে চার ভাগে ভাগ করে দিয়ে গিয়েছিলেন নিজ চার পুত্রের মধ্যে এবং একজন প্রধান খাকান নির্বাচন করে দিয়েছিলেন যার অধীনে থাকবে বাকি সবাই।

বড় ছেলে যোচিকে দেওয়া হলো গোল্ডেন হোর্ড বা ককেশাস অঞ্চল,চাগতাই খান পান বর্তমান কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, চীন এদিকের অংশ। ওগেদাই খান খাকান নির্বাচিত হন এবং বর্তমান মঙ্গোলিয়ার দিকের অধিপতি হন,এছাড়াও তুগলাই খান পারস্য সামলানোর দায়িত্ব পান৷ চেঙ্গিস খানের বড় ছেলে জোচি খান চেঙ্গিস খানের মতই ১২২৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন যদ্দরুন তার ছেলে বাতু খান গোল্ডেন হোর্ডের অধিপতি হন৷

১২৪১ সালে তৎকালীন খাকান ওগেদাই খান মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তী খাকান নির্বাচিত হন মংকে খান। এদিকে গোল্ডেন হোর্ডের শাসক বাতু খান মারা যান ১২৫৫ সালে ঘটনাপ্রবাহে তার স্থলে তার ছোট ভাই বারকে খান গোল্ডেন হোর্ডের অধিপতি হন।
সকল কিছুই ঠিকঠাক যাচ্ছিল, বিপত্তি ঘটে এই গোল্ডেন হোর্ডের অধিপতি বারকে খান যখন রাজধানী কারাকোরামে যাবার সময় বুখারায় পথিমধ্যে এক বাণিজ্য কাফেলাকে আটকান! সে কাফেলায় ছিলেন সূফী সাইফুদ্দীন(রহ) তার ইসলামের দাওয়াতে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে নেন চেঙ্গিস খানের নাতি এবং এক শক্তিশালী মোঙ্গল খানাতের এ শাসক বারকে খান। ইতিমধ্যে মংকে খান হালাকু খানের সাথে মুসলিম দুনিয়াকে ধবংসের পরিকল্পনা হাতে নেন। যার সবচেয়ে মোক্ষম ভূমিকা হতে পারত তৎকালীন আব্বাসীয় খিলাফত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ ধবংসের মাধ্যমে। ১২৫৮ সালে হালাকু বাগদাদকে একেবারে দুমড়ে,মুচড়ে শেষ করে ফেলেন। লিখেন ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম গণহত্যার ইতিহাস। যা জানতে পারলে বারকে খান ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে শপথ নেন প্রতিটি মুসলিমের প্রাণের বদলা নেওয়ার।

কিন্তু সুচতুর বারকে খান এও জানতেন একা মোঙ্গল সাম্রাজ্যকে পদানত করা সম্ভব নয়। তিনি প্রথমে মোঙ্গদের দূর্বল করার পন্থা অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এদিকে হালাকু বাগদাদ ধবংসের পর এগিয়ে যেতে লাগলেন মিশরে আইয়ুবীদের ধবংসস্তূপের উপর দাড়ানো মামলুক সাম্রাজ্যের দিকে। মামলুক সুলতান তখন ক্ষমতা লিপ্সু কুতুজ। যতই ক্ষমতা লিপ্সু হোক ইতিহাস তাকে বিস্মৃত করতে পারবে না আইনে জালুতের মহা কারনামার কারণে। রাজ্য হস্তান্তরের জন্য কঠোর ভাষায় হুমকি দিয়ে পত্র পাঠালেন হালাকু সুলতান কুতুজের কাছে। কুতুজ ইতিমধ্যেই মোঙ্গলদের দ্বারা পদানত শিবিরের কি অবস্থা হয় তা জানতেন, তাই তিনি লড়ে মরার সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দিলেন। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে কুতুজ দূত হত্যা করে তার জবাব দিলেন। মামলুক আক্রমনে সচেষ্ট হালাকু ঠিক তখনি খবর পান তৎকালীন খাকান মংকের প্রয়াণের৷ গ্রেট খানের অন্তিম সংস্কারে অংশ নেওয়ার জন্য হালাকু সংগে নিয়ে যান নিজের সৈন্যবাহিনীর এক বিরাট অংশকে রেখে যান সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র এক অংশ।
এদিকে হালাকুর অনুপস্থিতিতে বিখ্যাত সেনাপতি বাইবার্সের অধীনে আইনে জালুতে ঘটে গেল ইতিহাসকে চমকে দেওয়া এক ঐতিহাসিক লড়াই। ১২৬০ সাল পর্যন্ত কোন যুদ্ধে পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন না করা মোঙ্গল সাম্রাজ্য প্রথমবারের মত দেখল হারের মুখ। চূর্ন হলো তাদের অপরাজেয় খেতাব। ভয় পেয়ে চলে যাওয়া মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে আবারো ফিরে আসতে লাগল এই ভেবে যে, হ্যাঁ! তারাও অপরাজেয় নয় তাদেরো হারানো সম্ভব।

এদিকে বারকে খান এতদিন এরকমই কোন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তৎকালীন মোঙ্গলদের উত্তরাধীকার নির্বাচনের কোন সুনির্দিষ্ট পন্থা ছিলো না। চেঙ্গিস খানের যেকোন বংশধর খাকান পদ দাবি করতে পারত৷ যদ্দরুন খাকান নির্বাচন নিয়ে বিরোধ বাজল। হালাকু খান সমর্থন দিলেন কুবলাই খানকে অপরদিকে বারকে খান নিজকে না সমর্থন না দিয়ে দিলেন দিলেন আরিক বুকাকে৷ এভাবেই সুচিন্তিত ভাবে বেধে গেল মোঙ্গলদের ইতিহাসে প্রথম গৃহযুদ্ধ আরিকবুকা ও কুবলাই খানের মাঝে।
আইনে জালুতের কিছুদিন পর ক্ষমতালিপ্সু কুতুজকে তারই কিছু আমির হত্যা করলেন। ক্ষমতায় আসীন হলেন মামলুক বংশের প্রকৃত শাসক বিবেচিত সুলতান বাইবার্স। যোগসাজশ করলেন গোল্ডেন হোর্ডের অধিপতি বারকে খানের সাথে। অপরদিকে হালাকু খানও ভুলতে পারেন নি আইনের জালুতের সে লজ্জা। মামলুকদের ধবংস করতে এবার পূর্নোদ্যমে আবারো যাত্রা শুরু করলেন ইলখানাতের এ শাসক। আবারো মুসলিম আর মোঙ্গলদের মাঝে দেওয়াল দাড় করিয়ে দিলেন বারকে খান। নানা অজুহাতে বিরোধ বাজিয়ে দিলেন হালাকুর সাথে। নিজের প্রচন্ড ক্ষতি হলেও নুগাইর খানের মাধ্যমে পরাজিত করলেন তাকে,নিঃশেষ করে দিলেন হালাকুর শক্তিকে। যার পর হালাকু আর কখনই মুসলিম দের আক্রমণের সাহস দেখায় নি।

একদিকে আরিকবুকা-কুবলাই যুদ্ধ, অপরদিকে বারকে-হালাকু যুদ্ধ, মোঙ্গলদের শক্তি অনেকাংশেই নিঃশেষ করে দিয়েছিল।
আরিকবুকার সাথে কুবলাই জিতলেও মোঙ্গল সাম্রাজ্য আর বিভক্তি ঠেকাতে পারেনি। ওগেদাই এর উত্তরসূরীরা এবার দাবি করতে থাকে কুবলাই নয় তাদের ন্যায্য অধিকার ছিলো খাকান হওয়ার। এ নিয়ে আবারো অন্তর্দ্বন্দ শুরু হয়। মোঙ্গল সাম্রাজ্য ভেঙে চারটি ভিন্ন প্রদেশে পরিণত হয়ে যায়। গোল্ডেন হোর্ড,ইলখানাত,চাগতাই খানাত ও ইয়েন সাম্রাজ্য। পরপর ঘটে গেল হালাকু খান,বারকে খান, আবাকা খান,কুবালাই খানের মৃত্যু। একদিকে এত অন্তর্দ্বন্দ,অপর দিকে খানাত গুলোর টানা শাসকগোষ্টির মৃত্য, এছাড়াও দিনে দিনে মুসলিম, খ্রিষ্টান,বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি বিলীন করে দিতে লাগল মোঙ্গল অবশিষ্টাংশ সে খানাতগুলোকেও।১৩৭০ থেকে ১৩৮০ এ দশ বছরের মধ্যেই শুধুমাত্র গোল্ডেন হোর্ড ছাড়া বাকি তিন খানাতই তাদের অস্তিত্ব হারায়। মুসলিম শাসনাধীন গোল্ডেন হোর্ড ১৫’শ শতক পর্যন্ত তার শাসন চালিয়ে যায়।

ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের পতনের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবেই দেখানো হয় বারকে খানকে। নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ তৈরি করে তিনি যে আঘাত মোঙ্গোল জাতিকে ভিতর থেকে দিয়েছিলেন তারা তা পুনরায় কাটিয়ে উঠতে পারেনি,ঐক্যবদ্ধ মোঙ্গল একেবারে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এছাড়াও দূর্বল উত্তরাধিকার নীতি ও আইনে জালুতের সে ঐতিহাসিক যুদ্ধও মোঙ্গোলদের পতনের কারণ হিসেবে দেখানো হয়৷
এভাবেই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকারী এ জাতি ইতিহাসকে রক্ত দিয়ে ধৌত করে সে ইতিহাসেই বিলীন হয়ে যায়। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে তারা মুছে গেলেও পৃথিবীকে তাদের দেওয়া ঘা আজো পৃথিবীবাসী ঠিক উপশম করে উঠতে পারে নি।
মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ খান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আরো পড়ুন;
১.মোঙ্গলদের উত্থানের ইতিহাস https://cutt.ly/
২.মোঙ্গলদের ইসলাম গ্রহণের ইতিহাস https://cutt.ly/yjbuYeg
৩.মোঘল কবি মির্জা গালিবের জীবনী https://cutt.ly/Ejighot