বরফের রাজ্য এন্টার্কটিকা মহাদেশ

এন্টার্কটিকা পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নস্তরে অবস্থিত মহাদেশ। কিন্তু দ্বিমাত্রিক সমতলে আঁকার কারণে বিশ্ব মানচিত্রে এই মহাদেশের অবস্থান সর্ব দক্ষিণে।পৃথিবীর সাতটি মহাদেশ এর মধ্যে আয়তনের বিচারে এন্টার্কটিকার অবস্থান পঞ্চমে। কিন্তু বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এই মহাদেশ টি অন্য মহাদেশ গুলো কে ছাড়িয়ে প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে।
এন্টার্কটিকা একইসাথে বিশ্বের শীতলতম এবং শুষ্কতম মহাদেশ হিসেবে পরিচিত। এই মহাদেশের ‘ড্রাই ভ্যালি’ অঞ্চল পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে শুকনো এলাকা বলে চিহ্নিত।
চিত্রঃ ড্রাই ভ্যালি
এন্টার্কটিকা মহাদেশ এর মোট আয়তন ১ কোটি ৪২ লাখ বর্গ কি.মি. অথবা ৫৫০০০ বর্গ মাইল। আয়তনের হিসেবে এই মহাদেশ টি অস্ট্রেলিয়ার প্রায় দ্বিগুণ। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দেড় গুন বড়। সাউদার্ন সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত এই মহাদেশ এর প্রায় পুরোটাই বরফ দিয়ে ঢাকা। এন্টার্কটিকার স্থলভাগের উপর এই বরফের উচ্চতা কোন কোন জায়গায় প্রায় ৩ মাইল হলেও এখানকার বরফের গড় উচ্চতা প্রায় ২ কি.মি. বা ৬০০০ ফুট।
এন্টার্কটিকা মহাদেশ এর বর্তমান অবস্থা দেখে বুঝার উপায় না থাকলেও ১৬ কোটি বছর আগেও এই মহাদেশ টির অবস্থান ছিলো বিষুব রেখার কাছাকাছি। আগে পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশ একসাথে একটি সুপার কন্টিনেন্ট এ যুক্ত ছিলো। যারা নাম ছিলো ‘প্যানাজিয়া’। তখন বর্তমান এন্টার্কটিকা মহাদেশ এর জায়গা টি ছিলো ঘন বনে ঢাকা। যেখানে বিশালাকৃতির সব ডাইনোসর ঘুড়ে বেড়াত। কিন্তু এখন থেকে ১৭৫ মিলিয়ন বছর আগে ক্রেটাচিওয়াস পিরিয়ড এ এন্টার্কটিকা মহাদেশ প্যানাজিয়া ভেঙ্গে দক্ষিনমুখি যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে আরো প্রায় ১২০ মিলিয়ন বছর এই মহাদেশ জুড়ে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রানীর অবস্থান থাকলেও এক উল্কাপিন্ডের আঘাতে পৃথিবীর সব স্থলচর এবং উভচর ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো।
চিত্রঃ বিভিন্ন পিরিয়ডে সুপারকন্টিনেন্ট প্যানাজিয়া এর বিচ্যুতি
বিজ্ঞানিদের মতে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি বছর আগে এন্টার্কটিকা মহাদেশ এ প্রথম বরফ জমা শুরু হয়। কিন্তু বৈষ্ণিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পুরোপুরি বরফে ঢেকে যাওয়ার পরেও একাধিকবার এন্টার্কটিকার সব বরফ গলে যাবার ঘটনা ঘটেছে।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, অন্য মহাদেশ গুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হলেও পৃথিবীতে বিদ্যমান স্থলভাগ গুলোর মধ্যে এন্টার্কটিকার অবস্থান মানুষ জেনেছে সবার পরে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, রাশিয়া এন্টার্কটিকার একেবারে উলটোদিকে উত্তর মেরুর কাছাকাছি অবস্থিত হলেও এন্টার্কটিকা মহাদেশ টি আবিস্কার করেন রুশ দুই অভিযাত্রী ফেবিয়ান গোটলিয়েব ফন বেলিংশসেন এবং মিখাইল লাজারেভ। ১৮২০ সালে, এই দুই অভিযাত্রীর জাহাজ ‘ভস্টক’ এবং ‘মার্নি’ ওই বছর এন্টার্কটিকা উপকুল বর্তী ফিম্বুলাইজ সেল্ফ টি অতক্রম করেন। এর আগে অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার এর কৃতিত্বধারী জেমস কুক ১৭৭২-১৭৭৫ এর মধ্য ৪ বার এন্টার্কটিকা কে ঘিরে থাকা সাউদার্ন সাগর পাড়ি দিলেও এন্টার্কটিকার স্থলভাগ দেখার মতো দক্ষিনে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ১৮২০ সালে আবিষ্কৃত হলেও এন্টার্কটিকার দুরত্ব এবং দূর্গম আবহাওয়া কারণে এর পর আরো ৭৫ বছর এই মহাদেশ এর স্থলভাগে কোনো মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি।
১৮৯৫ সালে, নরওয়ের একদল অভিযাত্রীর মাধ্যমে এন্টার্কটিকা মহাদেশ এ প্রথম মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে। তবে এই মহাদেশ এর অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা হাজারো বৈচিত্র্য এখনো মানুষের অগোচরে রয়ে গেছে। তাই থেমে থাকেনি আবিষ্কার প্রক্রিয়া।
২০১৩ সালে, প্রথম বারের মতো বরফে ঢাকা এই মহাদেশ এ লুকিয়ে থাকা একাধিক সুপ্ত আগ্নেয়গিরির কথা বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন। ১৯০৭ সালে, আয়ারল্যান্ড এর অধিবাসী আর্নেস্ট হেনরি শেকলেটন এর নেতৃত্বে নিমরদ নামের অভিযাত্রী সদস্যরা চৌম্বকীয় দক্ষিন মেরু পাড়ি দেওয়ার পথে প্রথম বারের মতো ‘মাউন্ট এরেবাস’ নামক একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির চূড়া অতিক্রম করেন।
চিত্রঃ মাউন্ট এরেবাস আগ্নেয়গিরি
কিন্তু চৌম্বকীয় দক্ষিণ মেরু থেকে ফেরার পথে আচমকা তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় শেকলেটন এর অভিযাত্রী দলের জাহাজ টি বরফে আটকা পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সেই জাহাজ রেখেই বাকি পথ পায়ে হেটে ফিরে আসতে বাধ্য হয় তারা। কিন্তু থেমে থাকেনি আবিষ্কার এর নেশা।
অবশেষে ১৯১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরু বিজয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন নরওয়ের মেরু অভিযাত্রী রোয়াল্ড আমুন্ডসেন ও তার দল। এর ঠিক ১ মাস পর রবার্ট ফ্যালকন স্কট নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ অভিযাত্রী দল ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরু তে পৌছায়। দূর্ভাগ্যবশত ফিরে আসার সময় প্রচন্ড তুষার ঝড়ে দলটির রসদ হারিয়ে যাওয়ায় প্রত্যেকের ই মর্মান্তিক ভাবে মৃত্যু হয়।
এন্টার্কটিকা মহাদেশ এ কোনো স্থানীয় মানুষের বসবাস না থাকায় এখানে নেই কোনো জনপদ, জাতি বা রাষ্ট্র। তবে এই মহাদেশ টি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় পরিচালিত হয়। ১৯৫৯ সালে সম্পাদিত এবং ১৯৬১ সালে কার্যকৃত ‘এন্টার্কটিকা ট্রিটি সিস্টেম’ নামক চুক্তি অনুযায়ী এই মহাদেশ টি শুধুমাত্র গঠনমূলক বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এমন কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এখানে চালানো যাবেনা যার ফলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে পরিবেশ এবং জীব বৈচিত্রের কোনো ক্ষতি হয়। ঐ সময় এই চুক্তি তে ১২ টি দেশ সাক্ষর করলেও বর্তমানে ‘এন্টার্কটিকা ট্রিটি সিস্টেম’ এ সাক্ষরকারী মোটে দেশের সংখ্যা ৫৫। প্রথম ১২ টি দেশ হচ্ছে আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, চিলি, ফ্রান্স, জাপান, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। এন্টার্কটিকা মহাদেশ এর বিভিন্ন স্থানে এই ১২ টি দেশের প্রতিষ্ঠিত এবং নিয়ন্ত্রনাধীন অর্ধশতাধিক গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এই চুক্তি অনুসারে, প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে ২৮ টির ও বেশি দেশ থেকে অন্তত ৫০০০ বিজ্ঞানী এই মহাদেশে গবেষণার উদ্দেশ্যে বসতি প্রতিষ্ঠা করে। বছরের ৬ মাস এন্টার্কটিকার গবেষণা কেন্দ্র গুলো তাদের অস্থায়ী ঠিকানায় পরিনত হয়।এসব গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনাধীন ‘ম্যাকমার্ডো’ স্টেশন টি। প্রতি বছর এই কেন্দ্রে প্রায় ১০০০ বিজ্ঞানি এবং গবেষক এসে জড়ো হন। যার মধ্যে আছেন জীববিজ্ঞানী, ভুতত্ববিদ, সমুদ্রবিশেষজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞান,মহাকাশবিদ, হিমবাহ বিশেষজ্ঞ এবং গ্রহাণু বিশেষজ্ঞ। কিন্তু গবেষণার বাইরেও ইদানীং এন্টার্কটিকা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
চিত্রঃ ম্যাকমার্ডো স্টেশন
এন্টার্কটিকা মহাদেশ কে বিজ্ঞানীরা ২ ভাগে ভাগ করেছেন। এই মহাদেশ এর এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত ট্র্যান্সআন্টার্কটিক পর্বতমালার পশ্চিমে ওয়েস্ট এন্টার্কটিক এবং পুবে ইস্ট এন্টার্কটিকা অবস্থিত। ট্র্যান্সআন্টার্কটিক পর্বতমালার বিস্তৃতি ০° দ্রাঘিমাংশ বরাবর হওয়ায় ওয়েস্ট এন্টার্কটিকার অবস্থা পশ্চিম গোলার্ধে আর ইস্ট এন্টার্কটিকা পূর্ব গোলার্ধে। আয়তনের বিচারে ইস্ট এন্টার্কটিকা পশ্চিম অংশের প্রায় ১০ গুন বড় এবং জমে থাকা বরফের পুরুত্ব অনেক বেশি। বিজ্ঞানীদের মতে, এন্টার্কটিকা মহাদেশ এ জমে থাকা বরফের প্রায় ৭০ ভাগ ই এই ইস্ট এন্টার্কটিকায় অবস্থিত।
১৯৮৩ সালের ২১ এ জুলাই, রুশ গবেষণা কেন্দ্র ভস্টক এর ধারনকৃত তাপমাত্রা অনুযায়ী এই মহাদেশ এর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো -৮৯.২° সে.। যদিও সাধারণত এই মহাদেশ এর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -৮০° সে. এর কাছাকাছি হয়ে থাকে। অন্যদিকে এই মহাদেশ এর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫° থেকে ১৫° সে. এর মধ্যে উঠানামা করে। তবে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী, এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ধারন করা হয় ২০.৫° সে.। এই ছাড়া এই মহাদেশ এর বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত এর পরিমাণ মাত্র ৪ মিলিমিটার। যা সাহারা মরুভূমির অর্ধেক। এ কারণে এন্টার্কটিকা ই বিশ্বের বৃহত্তম মরুভূমি। মানবশূন্য হলেও এন্টার্কটিকা মহাদেশ এ রয়েছে নানা ধরনের জীব। সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো নীলতিমি, আর্কা বা খুনী তিমি, দানবীয় স্কুইট। এছাড়া উভচর প্রানীদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পেঙ্গুইন।
চিত্রঃ এন্টার্কটিকা মহাদেশ এর নীলতিমি
চিত্রঃ এন্টার্কটিকা মহাদেশ এর পেঙ্গুইন
বিশ্বের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় এই মহাদেশ কে পৃথিবীর ডিপ ফ্রিজ বলা হয়। এছাড়াও পৃথিবীতে মোট সঞ্চিত সুপেয় পানির শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ই এই মহাদেশ এ বরফ হিসেবে জমে আছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো, মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস এর পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণয়নের প্রভাব পড়ছে সুদূর এন্টার্কটিকাতে ও। ইতিমধ্যে বিপুল পরিমাণ বরফ সাগরের পানিতে মিশে গেছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১ শতকের মধ্যে পৃথিবীর অবস্থা হবে ভয়াবহ। এন্টার্কটিকায় জমে থাকা সব বরফ গলে গেলে বিশ্বব্যাপী সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা প্রায় ২০ মিটার বা ৬৫ ফুটের মতো বৃদ্ধি পাবে। ফলে উপকূলীয় সব জনপদ ই বিলীন হয়ে যাবে।
তার ফলে বিশ্বের পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হবে তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক- সায়মা আফরোজ (নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর AFB Daily)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Wanna go there at least once in my life.
Keep it up.
Thank you!
Ahhh!!! Antarctica, a place of white heaven!!
Save anterctica for save coast. It is an informative article.
Thank you!
Very informative writing!