মোবাইল জায়ান্ট নোকিয়ার উত্থান-পতনের আদ্যপান্ত

যদি ভুল না করি থাকি,বর্তমান জেনারেশনের বেশিরভাগ মানুষের জীবনের প্রথম ফোনটাই ছিল নোকিয়ার। এমন একটা সময় ছিল যখন মোবাইল মানেই ছিল নোকিয়া। অথচ এক সময়কার দুর্দন্ড প্রতাপশালী কোম্পানি নোকিয়া,আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর পেছনের গল্পটা জানার জন্য আমাদের যেতে হবে,সেই ১৯৮৫ সালে।যখন ফিনল্যান্ডে নোকিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত তারা ছিল একটি ইলেকট্রনিক্স নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। যাদের মূল ব্যবসা ছিল,সামরিক কাজের জন্য উপযোগী রেডিও কমিউনিকেশন ডিভাইস তৈরি করে দেয়া। আর তাদের ক্রেতার তালিকায় সবার আগে ছিল প্রতিবেশি সোভিয়েত ইউনিয়ন। নোকিয়ার অধিকাংশ ইলেকট্রিক যন্ত্র তারাই কিনে নিত। কিন্ত তারপর আসে দুর্যোগ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। আর একই সাথে ক্রেতা হারিয়ে ধুঁকতে থাকে নোকিয়া। ঠিক সেই সময়,তারা সিদ্ধান্ত নেয় শুধুমাত্র মোবাইল ডিভাইস তৈরির।

নোকিয়ার সফলতার যাত্রা শুরু হয়েছিল স্নায়যুদ্ধের শেষ দশকে,১৯৮২ সালে, মোবিরা নামক একটি মোবাইল নির্মাতা কোম্পানিকে কিনে নেওয়ার মাধ্যমে। তারপর থেকে নোকিয়া মোবাইল ডিভাইস তৈরিতে মনোনিবেশ করে।তাদের ডিজাইন করা প্রথম পোর্টেবল ডিভাইস ছিল একটি ‘কার ফোন’ বা গাড়িতে বহনযোগ্য ফোন। এই ফোনটির নাম ছিল ‘নোকিয়া মোবিরা সেনেটার’। এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম গাড়িতে বহনযোগ্য ফোন। ১৯৮৪ সালে পুরোপুরি বানিজ্যিকভাবে লঞ্চ করে যেকোনো স্হানে বহনযোগ্য ফোন ‘ নোকিয়া মোবিরা টকম্যান’। এর ওজন ছিল প্রায় ৫ কেজি। তারপর ১৯৮৭ সালে নোকিয়ার ‘মোবিরা সিটিম্যান’ ছিল পৃথিবীর প্রথম এক হাতে এবং হাতের মুঠোয় ব্যবহার করা সম্ভব এমন একটি ফোন। কারণ,এর ওজন ছিল মাত্র ৮০০ গ্রাম।যা আগের মোবাইলগুলোর থেকে অনেক হালকা। ফলে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে এই মোবাইল।
১৯৯২ সালে নোকিয়া বাজারে নিয়ে আসে তার,১০১১ সিরিজের ফোন। জিএসএম প্রযুক্তির এই ফোনগুলো বাজার কাঁপিয়ে বিক্রি হতে থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বী মটোরোলাকে টপকে খুব দ্রুতই বিশ্বের এক নম্বর মোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ১৯৯৬-৯৯ সালের মধ্যে পুরো ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়ায় নোকিয়ার একচ্ছত্র রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সেসময় নোকিয়া তার ২১০০ সিরিজের প্রায় ২ কোটি মোবাইল বিক্রি করে। যা তাদের ধারণার চেয়ে বেশি ছিল। আর তারপরই আসে,২০০৩ সাল,সে বছর নোকিয়া বাজারে তার ১১০০ মডেলের মোবাইলটি ছাড়ে। আর ক্রেতারা পঙ্গপালের মত এই সেটটি কিনতে ভীড় জমায়। ২০০৫ সাল নাগাদ সবার কাছে ধারণাই হয়ে গেছিল,মোবাইল মানেই নোকিয়া। তাদের সিমবিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের তৈরি ১১০০ মডেলের এই মোবাইল আজ অবধি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া মোবাইল ফোন।একই সাথে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসও।

তবে সবকিছুরই শেষ আছে। নোকিয়ায় শীঘ্রই তার শেষের শুরু দেখতে পায়। ০৫’র পর বাজারে থাকা স্যামসাং আর মটোরোলা কিছু ফ্লিপ ফোন বাজারে নিয়ে আসে। এই ফোনগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এদিকে অ্যাপল আর গুগল তাদের নতুন অপারেটিং সিস্টেমের ফোনগুলো বাজারে নিয়ে আসতে শুরু করে। ফলে দ্রুত কাস্টমারদের মধ্যে এই ফোনগুলো জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। এদিকে এশিয়ার মার্কেটে চীন তাদের ছোট মোবাইল ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে থাকে। যা দ্রুত বড় হয়ে ঊঠতে শুরু করে। তবে নোকিয়ার মূল সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়।অ্যাপল আর এন্ড্রয়েড যেখানে ডেভলাপার ফ্রেন্ডলি অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে মোবাইল তৈরি করতে থাকে।সেখানে নোকিয়া তার পুরানো সিমবিয়ান অপারেটিং সিস্টেম নিয়েই পড়ে থাকে। যেখানে অ্যাপলের কাছে ৩ লাখ আর গুগলের কাছে দেড় লাখ এপ্লিকেশন ছিল,সিমবিয়ানে ২০,০০০ অ্যাপও ছিল না। এটা ছিল এক মারাত্মক ভুল।

এই সময় নোকিয়া তার নতুন সিইও হিসবে নিযুক্ত করে,মাইক্রোসফটের সাবেক বিজনেস হেড স্টিফেন ইলোপকে। স্টিফেন ইলোপ নোকিয়াকে তখন বুদ্ধি দেয়,অন্যান্য ফোন কোম্পানির মত এপ্লিকেশন ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেমের সাথে নোকিয়াকে যুক্ত হতে। নোকিয়া তখন গুগলের সাথে যোগাযোগ শুরু করে।তাদের ফোনে এন্ড্রয়েড অ্যাপগুলো যুক্ত করতে। কিন্তু ইলোপ তাতে বাঁধা দিয়ে বলেন,এতে নোকিয়া অন্য কোম্পানির ভিড়ে হারিয়ে যাবে। তাই,তার বুদ্ধিতে নোকিয়া মাইক্রোসফটের সাথে মিলে একটি নতুন মোবাইল বানানোর কাজে হাত দেয়।যাতে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম থাকবে। কিন্তু তাদের হতাশ করে দিয়ে,নোকিয়ার লিউমিয়া সিরিজ ভয়াবহ ফ্লপ খায়। বিপরীতে এন্ড্রয়েড আর আইওএস বাজার দখল করে বসে আছে। ঠিক সেই সময়,নতুন সিইও ইলোপের চক্রান্তে মাইক্রোসফটের কাছে মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়ে যায়,এক সময়কার দুর্দন্ড প্রতাপশালী মোবাইল জায়ান্ট নোকিয়া। বর্তমানে নোকিয়া ব্র্যান্ড চালু আছে ঠিকই।তবে তারা এখন আর মোবাইল বানায় না। তাদের সাবেক কর্মীরা মাইক্রোসফটের কাছ থেকে ১০ বছরের জন্য ব্র্যান্ড স্বত্ব কিনে নোকিয়া মোবাইল বাজারজাত করছে।তবে এর আসল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফক্সকন। মূলত সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে না নিতে পারায়,নোকিয়ার এই পতন হয়।