তুরষ্কের ড্রোন বিপ্লবঃ নেপথ্যের গল্প

২০১৬ সালের মার্চ মাস,ইস্তাম্বুলের কাছেই একটা বিমানঘাঁটিতে শত শত মানুষের করতালির মধ্য দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক ড্রোন। তুরস্ক আজ দ্বিতীয় প্রজন্মের ড্রোন যোদ্ধার কাতারে শামিল হয়েছে।স্কুল শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে,তুরস্কের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের অসংখ্য মানুষ সেদিন,তাদের দেশের ইতিহাসের অন্যতম একটি বিজয়ের সাক্ষী হয়ে গেল। তবে পুরো গল্পটা এত রঙ্গিন না।

এর শুরুটা হয়েছিল,সেই ১৯৯৬ সালে,মার্কিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল ডায়নামিকসের থেকে মাত্র ৬টি ড্রোন কেনে,তুর্কি সেনাবাহিনী। তাদের উদ্দেশ্য ছিল,তুরস্কের কুর্দি অধ্যুষিত দুর্গম অঞ্চলে কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠি পিকেকে’র উপর নজরদারি। সেসময় পাহাড়ি এলাকায় পিকেকে যোদ্ধারা অবাধে হেঁটে বেড়াত। তাদের দলগুলো বিনা বাঁধায়,সেখানে রাজত্ব চালাত। শুরুতে পাওয়া এই ড্রোন,তুর্কি সেনাদের শুধু সতর্ক করার জন্যই ব্যবহার হত। কারণ,এই ড্রোনগুলো থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে,সেনাদের কাছে তথ্য পাঠাতে প্রায় ২০ মিনিট লেগে যেত। যুদ্ধের ময়দানে ২০ মিনিট যে,অনেক বড় সময়!
তাই,তুরস্ক এবার অন্য দেশের দিকে হাত বাড়ায়। ইজরায়েল থেকে ১০টি ‘হিরন’ ড্রোন অর্ডার করে,তুর্কি সেনাবাহিনী। কিন্তু ড্রোন হাতে পাওয়ার পরই,তুরস্ক বুঝতে পারে। ইজরায়েলিরা ইচ্ছে করেই,ড্রোনগুলো অনেক ফিচার অকেজো করে দিয়েছে। শুরু হয় দেন-দরবার,মামলা,সব কিছু সামলে ড্রোন পেতে প্রায় ১০ বছর লেগে যায়। ২০০৬ সালে ড্রোন হাতে পাওয়ার পর,সেগুলো ইজরায়েল থেকে অপারেটিভরা এসে চালাত। তবে এতে বিরাট সমস্যা ছিল। ড্রোনে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্য,ইজরায়েলের হাতে চলে যেত। এদিকে,ইজরায়েল তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্কের কাছে ড্রোন সরবরাহ করতে নিষেধ করে। ফলে,তুরস্ক এক বিরাট সমস্যার মাঝে পড়ে। তাদের সেই বিপদ আরো বেড়ে ২০১১ সালে এসে। কুর্দি গেরিলা সেদিন একযোগে,৬টি সামরিক ঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায়। ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে তুর্কি সেনারা!

তুরস্ককে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন,একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মুখ। তার নাম,সেলজুক বাইরাক্তার। ১৯৭৯ সালে তুরস্কে জন্ম নেয়া,এই ইঞ্জিনিয়ার তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করার জন্য অবস্থান করছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি প্রথম তুর্কি সেনাবাহিনীর ড্রোনের বিকল্প খুঁজে দিতে তুরস্কে এসে হাজির হন। সে সময়,তার অভিনব ড্রোন দেখে তুর্কি সেনাকর্তারা প্রশংসা করেন। তবে সেলজুকের সামনে তখন অন্য সমস্যা এসে পড়ে। ব্যাক্তিগতভাবে প্রচন্ড ধার্মিক সেলজুক আর তার পরিবারের এই ধর্মভীরুতাকে সহজ চোখে দেখেনি,তুরস্কের সেকুলার সেনবাহিনী। তাই,তখন আবার আমেরিকায় ফিরে যেতে হয়।সেখানে তিনি বিশেষ একটি মানববিহীন হেলিকপ্টারের ডিজাইন করছিলেন,যা যে কোনো দুর্গম জায়গায় যেতে পারবে। বেশ কয়েক বছর,আবার তুরস্ক থেকে তার ডাক আসে। তুরস্ক এবার ড্রোন তৈরির কাজে হাত দিচ্ছে। তুর্কি সেনাবাহিনীর নিজস্ব ড্রোন প্রজেক্ট ছিল। তবে তাদের সেই জন্য উপযোগী জনবল ছিল না। সেলজুক তাদের প্রথম উন্নত ড্রোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তুরস্কের নীতি নির্ধারকরাও সেলজুকের দিকে মনযোগ দিতে শুরু করলেন। এমনকি রাজনীতির সাথেও তার হালকা পরিচয় ঘটে গেল,যখন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ানের ছোট মেয়ে সুমিয়ে এরদোয়ানের সাথে সেলজুক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।

আর তার কয়েকবছরের মাথায়, তুরস্কের ড্রোন শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন সেলজুক। প্রতিষ্ঠা করলেন তার নিজের ড্রোন কোম্পানি, বাইকার মেকিনা। ওজনে হালকা,আকারে ছোট হওয়ায়,তার তৈরি বাইরাক্তার ড্রোন র্যাডারে প্রায় অদৃশ্য হয়ে থাকে। খালি চোখে কয়েক হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়া ড্রোন শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তবে ড্রোন নির্মাণ করলেও,অস্ত্রবহনে সক্ষম এমন ড্রোন নির্মাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি তুরস্কের কাছে ছিল না। এখানে তারা সাহায্য পায় ব্রিটিশ অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইডিএম এমডিএম থেকে। তারা ব্রিটিশ সরকারের বারণ সত্বেও গোপনে তুরস্কের কাছে,অর্থের বিনিময়ে ড্রোনে বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ প্রযুক্তি তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করে ইডিএম এমডিএম। পরবর্তীতে এই বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার জানতে চাইলে,ইডিম/বাইকার মেকিনা কেউই কোনো জবাব দেয়নি।

যাইহোক,অস্ত্রধারী ড্রোন নির্মাণে সফল তুরস্কের সফলতা জানতে বিশ্ববাসীকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। তুরস্ক শুরতেই,তার দেশে থাকা পিকেকে গেরিলাদের উপর সমানে ড্রোন হামলা চালাতে শুরু করে। এর ফলাফল হাতেনাতে পায় তারা। এখন আর আগেরমত করে,তুরস্কের পাহাড়ি এলাকায় হেঁটে বেড়ায় না,পিকেকে যোদ্ধারা। তাদের দেখামাত্র,মিসাইল মেরে উড়িয়ে দেয় বাইরাক্তার ড্রোন। এমনকি ২০১৩’তে ইরাকের ভেতর হামলা চালিয়ে পিকেকে’র সামরিক শাখার প্রধান আবদুল্লাহ ওজলানকে হত্যা করে। আর সিরিয়ার আফরিন থেকে শুরু করে ইদলিবে,তুর্কি ড্রোনবাহিনী সিরিয়ার আসাদ বাহিনীকে রীতিমত গুঁড়িয়ে দেয়। এই ঘটনা তুরস্কে এত সাড়া ফেলে যে,তুর্কি শিক্ষার্থীরা অপারেশন আফরিন নামে একটি মোবাইল গেইম বানিয়ে ফেলে। আর সেলজুক বাইরাক্তার রীতিমত জাতীয় নায়কে পরিণত হন।আজ সিরিয়া থেকে ইরাক,আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার যুদ্ধ,এমনকি দূরের লিবিয়াতেও তুর্কি ড্রোনের জয়জয়কার। তবে এত কিছুর পরও,তুরস্কের চলার পথ মসৃণ নয়। কারণ,দিনশেষে ড্রোন একটি প্রাণঘাতী অস্ত্র। শুধুমাত্র হত্যার জন্যই এই অস্ত্র ব্যবহৃত হয়। তুরস্কের অবাধ ড্রোনের ব্যবহারে যেমনি তার শত্রুরা পরাজিত হয়েছে। তেমনি দুর্ঘটনাবশত অনেক সাধারণ নাগরিকও প্রাণ হারিয়েছে। তবে,এই নিয়ে বিশ্বমোড়লরা চুপ।কারণ,তারাও একই অপরাধে অপরাধী। পরিশেষে শুধু,এটাই বলা যায়,তুরস্কের এই অগ্রযাত্রা বিশ্বরাজনীতিকে নতুন মেরুকরণের দিকে ঠেলে দিবে।