ইরাক-কুয়েত: উপসাগরীয় যুদ্ধ বা গাল্ফ ওয়ার।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত যুদ্ধটি ইরাক এবং কুয়েতের মধ্যকার ১৯৯০ সালে প্রায় ৭ মাস ব্যাপী চলা যুদ্ধটিকে বোঝায়। ২০১৬ সালের বলিউডের বিখ্যাত সিনেমা “এয়ারলিফট” এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়েই বানানো। যুদ্ধের সময় ভারত সরকার প্রায় ২ মাস ধরে তার ২ লক্ষ নাগরিককে কুয়েত থেকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চাঞ্চল্যকর ঘটনাকে ঘিরেই তৈরি হয় এই সিনেমা।
১৯৯০ এর ২রা আগস্ট ইরাক তার প্রতিবেশী দেশ কুয়েতে অতর্কিত হামলা করে বসে। এই অতর্কিত হামালায় কুয়েতি সামরিক বাহিনী অপ্রস্তুত অবস্থায় খুব বাজে ভাবে পর্যদুস্ত হয় এবং কুয়েতের আমির তার পরিবারসহ প্লেনে করে সৌদি আরব পালিয়ে যান। হামলার দুই দিনের মধ্যেই কুয়েতের সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েতকে ইরাকের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষনা করেন।
ইরাকের কুয়েত আক্রমনের পেছনে কয়েকটি কারন ছিলো।
১. ১৯৮০ থেকে ৮৮ পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধে কুয়েত ইরাকের পক্ষ অবলম্বন করে এবং ইরাককে প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ইরাকের পক্ষে কুয়েতের এই বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
২. ইরাক এই বিশাল ঋণ শোধ করার উপায় হিসেবে বিশ্ববাজারে তেলের রপ্তানী কমিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে চায়। সেইসাথে কুয়েতকেও অনুরোধ করে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিতে। কিন্তু কুয়েত এই প্রস্তাবে রাজী না হয়ে বরং তেলের সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়।
৩. সাদ্দাম হোসেন দাবী করেন কুয়েত অবৈধভাবে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ইরাকের ভূখন্ড থেকে তেল উত্তোলন করছে। যদিও কুয়েত এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে।
৪. সাদ্দাম হোসেন এর মতে ইরান-ইরাক যুদ্ধের ফলে ইরানের প্রভাব বলয় থেকে মুক্তি পেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ আসলে লাভবানই হয়েছে। তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কুয়েত, সৌদি সহ অন্যান্য দেশের উচিত ইরাকের সকল ঋণ মৌকুফ করে দেয়া। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কুয়েত সহ অন্যান্য দেশ এই ঋণ মৌকুফ করতে অস্বীকার করে।
এসব কারনে ইরাক-কুয়েত সম্পর্ক একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ২রা আগস্ট মধ্যরাতে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইরাকি বাহিনী বর্ডার পার হয়ে কুয়েতের ভূখন্ডে ঢুকে পড়ে। কুয়েতের সেনাবাহিনী হঠাৎ এই তীব্র আক্রমণে হতচকিত হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ইরাকি সেনারা কুয়েতের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং কুয়েতের আমিরের বাসভবন দখল করে নেয়, যদিও আমির সপরিবারে বিমানে করে সৌদি আরবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তীব্র আক্রমনের ফলে খুব দ্রুতই কুয়েত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং সাদ্দাম হুসাইন কুয়েতকে ইরাকের ১৯তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।
ইরাকের এই আগ্রাসনের প্রতিবাদস্বরূপ জাতিসংঘ এই আগ্রাসনকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং ইরাককে কুয়েত থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানায়। এরপর আরব লীগের সমাবেশেও ইরাকি আগ্রাসনকে অবৈধ ঘোষণা করে ইরাকী সৈন্যপ্রত্যাহারে নির্দেশ দেয়া হয়। এতকিছুর পরও ইরাক কুয়েতের ভুখন্ড থেকে হটতে নারাজ। শেষে পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে যুদ্ধের ময়দানে নামে আমেরিকা। আমেরিকা তার ৪ টি যুদ্ধযাহাজ পারস্য উপসাগরে মোতায়ন করে এবং একই সাথে আরো ৩৪ টি দেশের সাথে ঐক্য গঠন করে ইরাকের বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনী গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনীর মধ্যে ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, মিশর, তুরস্ক সহ অন্যান্য দেশ মিলিয়ে মোট ৬ লক্ষ ৬০ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বহর সৃষ্টি হয়।
এত আয়োজন দেখে ইরাক এবার একটু নমনীয় স্বরে কথা বলতে শুরু করে। ইরাক দাবী করে যে ইরাক তখনই কুয়েত থেকে সৈন্য অপসারণ করবে যখন সিরিয়া লেবানন থেকে এবং ইসরাইল ফিলিস্তিনে দখলকৃত অবৈধ অঞ্চল হতে সৈন্য প্রত্যাহার করবে। তবে আমেরিকার ভাষ্য ছিল, প্রথমে ইরাককে কুয়েত থেকে সৈন্য অপসারণ করতে হবে এবং তারপর অন্যান্য দেশের কথা আসবে। কিন্তু ইরাক তার কথায় অনড় থাকে এবং আমেরিকায় কিছু হটতে নারাজ। শেষমেষ মিত্রবাহিনীর অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম শুরু করার মাধ্যমে সূচনা হয় পার্সিয়ান গালফ যুদ্ধের।
মিত্রবাহিনীর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ৩ টি
১. ইরাকের বিমানবাহিনী ধ্বংস করা। মিত্রবাহিনীর আধুনিক যুদ্ধবিমানের সামনে ইরাকি বিমানবাহিনী তেমন কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারে নি।
২. মিত্রবাহিনীর দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল ইরাকের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া, যাতে যুদ্ধরত সৈন্যদের কাছে কোনো বার্তা বা খবরাখবর না পৌঁছায়।
৩. মিত্রবাহিনীর ৩য় লক্ষ্য ছিলো ইরাক এবং কুয়েতের মধ্যে ইরাক কর্তৃক দখলকৃত সামরিক স্থাপনাগুলো বিধ্বস্ত করা। মিত্রবাহিনী একইসাথে বিমান হামলা চালায় ইরাকের পাওয়ার প্ল্যান্ট, নৌ-বন্দর, তেল শোধনাগার, রেলওয়ে স্টেশন, ব্রিজ ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে।
ইরাকি বাহিনীও তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে মিত্রবাহিনীর সকল আক্রমন ঠেকাতে এবং প্রতি-আক্রমন করতে। কিন্তু ৩৪ টি দেশের মিলিত শক্তি সেইসাথে আমেরিকার মত সুপার-পাওয়ারের সক্রিয় অংশগ্রহনে ইরাকি বাহিনীর অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পরে। শেষ চেষ্টা হিসেবে ইরাক ইসরাইল আক্রমন করে এই আশায় যে, ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে যুদ্ধে জড়য়ে ফেলতে পারলে হয়তো অন্যান্য মুসলিম দেশ ইরাকের পক্ষ অবলম্বন করবে অথবা নিরপেক্ষ হয়ে যাবে। কিন্তু ইসরাইল যুদ্ধ অংশগ্রহণ করে না বিধায় ইরাকের এই পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়।
চারদিক থেকে পর্যুদস্ত ইরাক এই যুদ্ধ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছিলো। অবশেষে ২২ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের দেয়া অস্ত্রবিরতীর চুক্তিতে ইরাক খুব সহজেই সম্মত হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ইরাক কুয়েত থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে। তবে কুয়েত থেকে ফিরে আসার পূর্বে এসব সৈন্যরা কুয়েতের বেশ কিছু তেলক্ষেত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে কুয়েত-ইরাক হাইওয়ে দিয়ে ফেরতরত ইরাকি সৈন্যের বহর লক্ষ্য করে মিত্রবাহিনী পুনরায় বিমান হামলা শুরু করে। এই বিমান হামলা এতটাই তীব্র ছিল যে তাতে বিপুল পরিমাণ ইরাকি সৈন্যের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্য দিয়েই শেষ হয় উপসাগরীয় যুদ্ধ।
যুদ্ধ শেষে কুয়েতের আমির সপরিবারে দেশে ফিরে আসেন। এই যুদ্ধে ২৪৮ জন মিত্রবাহিনীর সেনা এবং ২৫,০০০ জন ইরাকি সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। মিত্রবাহিনী পরিচালিত অপেরাশন ডেজার্ট স্টর্মের ফলে প্রায় ১,০০,০০০ বেসামরিক ইরাকি নাগরিক মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালে সাদ্দাম হুসাইন ইরাকের কুয়েত আগ্রাসনকে বড় ভুল ছিল বলে স্বীকার করেন।